Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

ধসেছে উড়ালপুল, বাবা তার রাত-তারা

আকাশ মেঘে ঢাকলে মনখারাপ হয়ে যায় ছোট্ট রূপসার। তারায় ভরা রাতের আকাশটাই যে বড় প্রিয় তার। ওই তারাদের মাঝেই যে রয়েছে বাবা। ঘুমোতে যাওয়ার আগে তারা হয়ে যাওয়া বাবাকে দেখা চাই-ই চাই। মা-ঠাকুমা ভাবে, মেয়ে বুঝি ভুলে গিয়েছে বাবাকে।

ছেলেমেয়ের সঙ্গে রিঙ্কি। নিজস্ব চিত্র

ছেলেমেয়ের সঙ্গে রিঙ্কি। নিজস্ব চিত্র

সুপ্রকাশ মণ্ডল
কল্যাণী শেষ আপডেট: ৩১ মার্চ ২০১৭ ০২:০১
Share: Save:

আকাশ মেঘে ঢাকলে মনখারাপ হয়ে যায় ছোট্ট রূপসার।

তারায় ভরা রাতের আকাশটাই যে বড় প্রিয় তার। ওই তারাদের মাঝেই যে রয়েছে বাবা। ঘুমোতে যাওয়ার আগে তারা হয়ে যাওয়া বাবাকে দেখা চাই-ই চাই। মা-ঠাকুমা ভাবে, মেয়ে বুঝি ভুলে গিয়েছে বাবাকে। কিন্তু রাত ফুরোলে মেয়ে শুধোয়, ‘‘অনেক দিন হয়ে গেল, বাবা কবে ফিরবে?’’

এ প্রশ্নের উত্তর জানেন না গোকুলপুরের রিঙ্কি দেবনাথ। নিতান্ত সাদামাটা একতলা বাড়িটায় বসে তিনি অস্ফুটে বলেন, ‘‘ওকে কী উত্তর দেব? এক বছর ধরে এই প্রশ্নের উত্তর তো আমিও খুঁজছি।’’ বলতে-বলতে নিজের কথায় নিজেই যেন চমকে উঠলেন তিনি— ‘‘এক বছর হল, না? মনে হচ্ছে, যেন কত দিন।’’

গত বছর ৩১ মার্চ হুড়মুড় করে ভেঙে পড়েছিল পোস্তার নির্মীয়মাণ উড়ালপুল। মৃতদের তালিকায় ছিলেন রিঙ্কির স্বামী সুজিত দেবনাথ, ডাকনাম বাপি। পঞ্জাব থেকে হাওড়া স্টেশন হয়ে সে দিন দুপুরে সপরিবার গাড়িতে নদিয়ার গয়েশপুরে নিজেদের বাড়িতে ফিরছিলেন তাঁরা। উড়ালপুল ভেঙে পড়ে গাড়ির উপরে। সুজিতের প্রাণহীন দেহ বাড়ি ফেরে। মারা গিয়েছিলেন গাড়ির চালক, হরিণঘাটা দাসবেড়িয়ার প্রশান্ত ঢালিরও।

উচ্চ মাধ্যমিক স্টার পেয়েও রুজির খোঁজে মালয়েশিয়া পাড়ি দিয়েছিলেন গরিব পরিবারের প্রশান্ত। ভাগ্য ফেরেনি। বাড়ি ফিরে গাড়ি চালকের কাজ নিয়েছিলেন। বিয়ে সুখের হয়নি। বাড়ি ছেড়ে চলে যান স্ত্রী। সে দিন গাড়ি চালিয়ে ফেরার সময়ে প্রশান্তের মোবাইলে তাঁর স্ত্রীর ফোন এসেছিল। কথা বলবেন বলে গাড়ির গতি ঈষৎ কমিয়েছিলেন তিনি। রিঙ্কির আক্ষেপ, ‘‘না হলে হয়তো বেঁচে যেত ওরা।’’

প্রশান্তের কাছে থাকতেন তাঁর বৃদ্ধ বাবা নিতাইচন্ত্র ঢালি। এখন অন্য দুই ছেলে তাঁর দেখভাল করেন। প্রশান্তের স্ত্রীর সঙ্গে তাঁদের আজও যোগাযোগ নেই। সাড়ে তিন বছরের নাতিকেও দেখেননি অনেক দিন। ক্ষীণ স্বরে বৃদ্ধ বলেন, ‘‘শুনেছি, বউমা কয়েক লক্ষ টাকা পেয়েছে। চাকরিও পাবে বলে শুনেছি। ছেলেটা আর ফিরবে না।’’

রিঙ্কি সাত লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন। কল্যাণী মহকুমাশাসকের অফিসে চাকরি জুটেছে মাস দেড়েক আগে। আট বছরের শুভ্রজিৎ আর সাড়ে তিন বছরের রূপসাকে বাড়িতে রেখেই কাজে যান। চোখের কোলের ঘাম আঁচলে মুছে নিয়ে রিঙ্কি বলেন, ‘‘শুভ্রজিৎ কিন্তু বুঝে গিয়েছে। মাস কয়েক আগেও ঘুড়িতে বেঁধে বাবাকে চিঠি পাঠাত। এখন ডায়েরিতে বাবার কথা লেখে। ডায়েরিটা সে কাউকে দেখায় না।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Vivekananda flyover Flyover collapse Rinki Debnath
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE