‘নেপাল, ও নেপাল....’ কোনও সাড়া নেই।
এ বার রেগে গিয়ে বিপদসুন্দর দত্ত হাঁক দিলেন, ‘বলি, অ্যাই ন্যাপলা....’
এ বার সাড়া মিলল। ‘আসচি বাবু...’ বলতে বলতে সামনে এসে দাঁড়ালেন নেপাল। নেপাল বিপদের বাড়ির ফাইফরমাস খাটেন। বিপদ বললেন, ‘নাহ্, আজ আর কেউ আসবে না। আমাকে চা দিয়ে দে। বেলা পড়ে আসছে।’
বৃষ্টি ততক্ষণে ধরে এসেছে। কিন্তু দাবাটা খেলা হবে না ভেবে মনটা খচখচ করছিল বিপদের। গরম চায়ে চুমুক দিয়েছেন, এমন সময় একটা রিকশা এসে থামল বারান্দার সামনে। এই অবেলায় আবার কে? নেপাল দেখে এসে খবর দিলেন, ‘বাবু, সোমক দাদাবাবু আর রোহন দাদাবাবু এয়েছে গো।’
হাজার ওয়াটের হাসি খেলে গেল বিপদের মুখে। সোমক আর রোহন তাঁর দুই ভাগ্নে। কলেজ পড়ুয়া দুই ভাই ছুটিছাটা পেলে কলকাতা থেকে সটান হাজির হয়ে যায় কান্দি লাগোয়া গ্রামে। মামাকে প্রণাম করতেই বিপদবাবু বললেন, ‘আগে ঘরে চল। মুখে কিছু দে।’ আচমকা দুই ভাগ্নেকে পেয়ে বিপদবাবু এতটাই মেতে উঠলেন যে, তাঁকে দেখে কে বলবে, দাবা খেলার সঙ্গীরা আসেননি বলে কিছুক্ষণ আগে তিনি মুহ্যমান ছিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে গরম লুচি-তরকারি হাজির সোমকদের সামনে। খেতে খেতে সোমকই কথাটা পাড়ল, ‘বড় মামা, রাহুলদের খবর কী? ওরা কি আজ আসবে?’ রাহুল সোমকের মাসির ছেলে। তার এক ভাইও আছে। একটা বড় মাঠ পার হলেই তাদের গ্রাম।
বিপদ বললেন, ‘কী করে আসবে? ওরা কি জানে, তোরা এসে হাজির। কাল সকালে লোক পাঠিয়ে খবর দেব।’ রোহন কিন্তু দমে যাওয়ার ছেলে নয়। সে বলল, ‘এত দূর থেকে এলাম। ওরা না এলে জমে নাকি! আমরা বরং চলে যাই। ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই তো ফিরে আসব।’ এ বার বিপদ বললেন, ‘সন্ধ্যার মুখে ও কথা আর উচ্চারণ করিস না। বিকেলের পর আর ওই মাঠ পার হয়ে কেউ যায় না।’
‘কেন মামা?’ সোমকের প্রশ্নে বিপদ বলেন, ‘সে অনেক কথা। ও শুনে তোদের কাজ নেই।’ কিন্তু কলেজ পড়ুয়া তরুণদের তা না শুনে যেন শান্তি নেই। তাঁদের জেদের কাছে হার মানতে হল বিপদকে। সন্ধ্যা নেমেছে কিছু আগে, এ বার বৃষ্টি নামল। বৈঠকখানার ঘরে হাজির পরিবারের অন্য সদস্যরা।
চায়ে চুমুক দিয়ে বিপদ শুরু করলেন, ‘বছর বিশেক আগের কথা, বুঝলি। রাহুলের মা, মানে তোদের মাসি রূপার সবে বিয়ে হয়েছে। আমি গিয়েছি তাঁর বাড়ি। কথায় কথায় রাত হয়ে গিয়েছে। ওরা ফিরতে দেবে না। কিন্তু আমি বেরিয়ে পড়লাম। মাঠের মাঝে একটা বাঁশবাগান। কিছুটা এসেই দেখি, একটা ছোট চিমনি লণ্ঠন যেন বাঁশ ঝাড়ের আড়ালে জ্বলছে। ওখান থেকে আমাদের বাড়িটা দেখা যায়। আমি এগোতে লাগলাম। দেখি, সেই চিমনি লণ্ঠন আমার সঙ্গে এগোতে লাগত। কিন্তু লন্ঠনটা যে নিয়ে যাচ্ছে তাকে দেখতে পাচ্ছি না।’
একটু দম নিয়ে ফের শুরু করেন বিপদ, ‘সে দৃশ্য দেখে প্রথমে হকচকিয়ে গিয়েছিলাম। পরে মনের মধ্যএ চেপে বসল ভয়। হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলাম। আচমকা শুনি কে যেন বলছে, ‘কী রে, বাতি নিবি? প্রথমে ভাবলাম, ভুল শুনছি। কিছুক্ষণ পরে ফের সেই এক প্রশ্ন শুনলাম। আমি আরও জোরে হাঁটতে লাগলাম। আমি এগোয়, লণ্ঠনও এগোয়। এতক্ষণ যে কণ্ঠ আলো নেওয়ার জন্য জোরাজুরি করছিল, সে এ বার হুমকি দিল—‘কী রে বার বার বলছি। শুনতে পাচ্ছিস না? আলোটা কি নিবি না?’ যে লণ্ঠন আমার পাশে পাশে চলছিল, এ বার সেটা কার্যত আমার পথ আটকে দাঁড়াল।’
বিপদের গলা তখন কাঁপছে, ‘আমি ছুটতে শুরু করি। দেখি, কে যেন আমার পিছন পিছন ছুটছে। বাঁশ বাগান পার হলেই আমাদের বাড়ি। প্রায় বাড়ির কাছাকাছি এসে আমি পড়ে যাই। তার পর আর কিছু মনে নেই। পরে বাবার কাছ থেকে শুনি, গ্রামেরই এক খুড়ো আঁধার রাতে বাঁশ বাগানে গিয়ে সাপের ছোবল খেয়ে মরে পড়েছিলেন। তার পর থেকেই খুড়োর ভূত রাতবিরেতে লন্ঠন নিয়ে ঘোরে।’ বাল্বটা দিব্যি জ্বলছিল। গল্প শেষ হতেই সেটা নিভে গেল। (শেষ)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy