এ ভাবে আর কত দিন...? সাগরদিঘির একটি প্রাথমিক স্কুলে অর্কপ্রভ চট্টোপাধ্যায়ের তোলা ছবি।
তিন মাস ধরে মিড ডে মিলের টাকা পাচ্ছে না সাগরদিঘির শ’তিনেক স্কুল। ধার করে এতদিন কোনও মতে মিড ডে মিল চালাচ্ছিলেন স্কুল কর্তৃপক্ষ। এ বার টাকা চেয়ে তাগাদা দিতে শুরু করেছেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। এমন অবস্থায় স্কুল কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, এ ভাবে আর পড়ুয়াদের মুখে খাবার তুলে দেওয়া সম্ভব নয়। টাকা না পেলে ১ মার্চ থেকে তাঁরা মিড ডে মিল বন্ধ করে দেবেন।
শুক্রবার একটি শিক্ষক সংগঠন বিষয়টি লিখিত ভাবে বিডিওকে জানিয়েছে। ওই সংগঠনকে সমর্থন জানিয়েছেন কংগ্রেসের পশ্চিমবঙ্গ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি ও তৃণমূলের প্রাথমিক শিক্ষা-সেলের নেতারাও। তাঁদের প্রশ্ন, আশপাশের সমস্ত ব্লকের স্কুলগুলির অ্যাকাউন্টে মিড ডে মিলের টাকা অগ্রিম জমা পড়ছে। সেখানে সাগরদিঘি ব্যতিক্রম কেন? এমন অবস্থার জন্য সব সংগঠনই দুষছে প্রশাসনের গাফিলতিকেই।
এই ধরনের গাফিলতি রুখতে গত ৬ মাসে কেন্দ্রের তরফে দফায় দফায় চিঠি লিখে মিড ডে মিলের বিষয়ে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রকের অধিকর্তা গয়া প্রসাদ থেকে যুগ্মসচিব জে আলম একাধিক বার জেলাগুলিতে লিখিত নির্দেশও পাঠিয়েছেন। সেখানে বলা হয়েছে— ১) কোনও স্কুলে পরপর তিন দিন বা মাসের মধ্যে ৫টি কার্যদিবসে মিড ডে মিল বন্ধ থাকলে তার জন্য দোষী চিহ্নিত হওয়া ব্যক্তির বিরুদ্ধে রাজ্য সরকারকে কড়া ব্যবস্থা নিতে হবে। ২) বরাদ্দ আর্থিক ফান্ড ও চাল যথাসময়ে স্কুলে না পৌঁছনোটাও কর্তব্যে গাফিলতি হিসেবেই গণ্য করা হবে। ৩) যদি এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকারের কোনও কর্মীর গাফিলতি থেকে থাকে, তা-ও দ্রুত জানাতে হবে মন্ত্রককে। ৪) মিড ডে মিলের জন্য বরাদ্দ অর্থ অন্তত এক মাস আগে স্কুলগুলির নিজস্ব ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দিতে হবে।
গোটা জেলার সব স্কুলে মিড ডে মিল চলছে এই গাইড লাইন মেনেই। অথচ সাগরদিঘিতে শিক্ষকদের তা চালাতে হচ্ছে স্থানীয় বাসিন্দাদের থেকে ধার-দেনা করে! সাগরদিঘি ব্লকের দু’টি চক্রে প্রাথমিক স্কুল রয়েছে ১৫৫টি। ৬৬টি শিশু-শিক্ষাকেন্দ্র, ১১টি মাধ্যমিক শিক্ষাকেন্দ্র এবং প্রায় ৬০টি হাই ও জুনিয়র হাইস্কুল। ডিসেম্বর, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি, এই তিন মাসে মিড ডে মিল বাবদ প্রতিটি স্কুলের গড় পাওনা দাঁড়িয়েছে ৫০ হাজার থেকে ১ লক্ষ টাকা। স্কুলকে ধার দেওয়া টাকার জন্য শিক্ষকদের বাড়ি গিয়ে তাগাদা দিতে শুরু করেছেন সব্জি বিক্রেতারা।
রঘুনাথগঞ্জ চক্রের কুলোরি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বিশ্বজিৎ পাণ্ডে বলেন, “টাকার অভাবে মিড ডে মিল বন্ধ হয়নি কখনও। গত সপ্তাহেই স্কুলের অ্যাকাউন্টে মার্চ মাসের জন্য অতিরিক্ত ১১ হাজার টাকা জমা পড়ে গিয়েছে।” সুতির ব্লক তৃণমূলের সভাপতি ওবাইদুর রহমান নিজে কারবালা কাজী নজরুল ইসলাম প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তিনি বলেন, “ওই ফান্ডে সব সময় বাড়তি টাকা জমা পড়ে। টাকা ধার করে সরকারি মিড ডে মিল চালাবেন কেন শিক্ষকেরা! সাগরদিঘিতে গাফিলতি কার তা বের করতে হবে প্রশাসনকেই।”
সিপিএমের প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির জোনাল সম্পাদক আব্দুল ওয়ারেশ বলছেন, “কোনও স্কুলে শিক্ষকেরা নিজেরাই মিড ডে মিল চালাচ্ছেন, কোথাও আবার স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মেয়েরা। তিন মাসে অনেক স্কুলেই বকেয়া দাঁড়িয়েছে প্রায় লক্ষ টাকা। দানধ্যানে সরকারের খরচের শেষ নেই। অথচ সরকারি প্রকল্পের টাকা কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যে পাঠিয়ে দেওয়া সত্ত্বেও, তা সাগরদিঘির স্কুলগুলোতে পৌঁছচ্ছে না।’’
তৃণমূলের প্রাথমিক শিক্ষাসেলের জেলার সহ-সভাপতি রফিকুল ইসলাম অবশ্য এই ঘটনার পিছনে প্রশাসনিক শৈথিল্যতার অভিযোগ তুলেছেন। তিনি আবার জেলা পরিষদের তৃণমূল সদস্যও। সাগরদিঘির শীতলপাড়া প্রাথমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক রফিকুল বলছেন, “এতে রাজ্য সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। আসলে আমলা-তান্ত্রিক অভ্যেস এখনও প্রশাসনে দূর হয়নি। মিড ডে মিল বন্ধ হলেই গ্রামগঞ্জে হইচই শুরু হবে। তার দায় নিতে হবে প্রশাসনকেই।”
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, অন্য ব্লকের সব স্কুলগুলোতে মিড ডে মিল নিয়ম মেনে চললেও সাগরদিঘিতে এমন পরিস্থিতি তৈরি হল কেন? যার কোনও সদুত্তর মিলছে না প্রশাসনের কর্তাদের কাছে। সাগরদিঘির বিডিও দেবব্রত সরকারের সাফাই, ‘‘যা টাকা পাওয়া গিয়েছিল, তা শেষ হয়ে গেছে। তাই সমস্যা হয়েছে।’’ তাঁর আশ্বাস, ‘‘সাত দিনের মধ্যে দেখছি কী করা যায়।” যা শুনে শিক্ষকেরা বলছেন, ‘‘এই তিন মাসে বহু বার বলেও বিডিও কিছু করেননি। কোন ম্যাজিকে তিনি সাত দিনে সমস্যার সমাধান করবেন তা একমাত্র তিনিই জানেন।’’
বিষয়টি জানতে চেয়ে জেলাশাসক ওয়াই রত্নাকর রাওকে একাধিক বার ফোন করা হলে তিনি ফোন ধরেননি। উত্তর মেলেনি এসএমএসেরও। আর মিড ডে মিলের ভারপ্রাপ্ত জেলার অতিরিক্ত জেলাশাসক (সাধারণ) শ্যামল মণ্ডল বলছেন, “কই, বিডিও আমাকে তো এ বিষয়ে কিছু জানাননি। জেলায় সদ্য দায়িত্ব নিয়েছি। তাই বলতে পারছি না গলদটা ঠিক কোথায়। তবে বিডিওর সঙ্গে কথা বলে অবশ্যই সমস্যা মেটানোর চেষ্টা করব।”
শিক্ষকেরা অবশ্য বলছেন, ‘‘প্রশাসনের এই আশ্বাস শুনতে শুনতে আমরা ক্লান্ত। ধার করে মিড ডে মিলের ব্যবস্থা করে এখন আমরাই বিপদে পড়েছি। রাস্তাঘাটে সব্জি বিক্রেতা, মুদি ব্যবসায়ীর সঙ্গে দেখা হলেই শুনতে হচ্ছে, ‘‘মাস্টারমশাই টাকাটা তাহলে কবে পাচ্ছি?’ এ কী বিপদ বলুন তো?’’
পশ্চিমবঙ্গ শিক্ষক সমিতির ব্লক সভাপতি গোলাম মহম্মদ আজাদের কথায়, “আর ক’দিন পরেই তো প্রশাসনের কর্তারা ভোট নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বেন। তখন আর মিড ডে মিলের কথা কে শুনবেন!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy