সমশেরগঞ্জের লোকশিল্পী জ্ঞানেন্দ্র বৈরাগী। ছবি: অর্কপ্রভ চট্টোপাধ্যায়
মনের মধ্যে জমাট বেঁধে রয়েছে ক্ষোভ। নামেই লোকশিল্পী। কিন্তু কাজ জোটে কই। সেই তো সংসার টানতে দিনমজুরি করতে হয়। নয়তো রোদ-ঝড়-জল মাথায় করে গ্রামের রাস্তায় ফেরি করে বেরানো, ‘‘হরেক মাল... হরেক মাল দশ টাকায়।’’ কেউ আবার সব্জি বেচেন বাজারে। শুধু মনের একটা আশা ক্ষীণ হয়ে এখনও বেঁচে, এ বার বুঝি দিন ফিরবে।
কিন্তু কই! ভোট আসে, ভোট যায়। দিন আর ফেরে না।
মুর্শিদাবাদের গ্রামেগঞ্জে এখনও তাঁদের দেখা মেলে। কখনও সং সেজে আলকাপের আসরে, কখনও আবার কবিগানের দলে। কেউ বা থাকেন পালাকীর্তন কিংবা বিষহরির মঞ্চে।
রাজনৈতিক দলগুলো যে ধর্মকর্মে বিশ্বাস করে না, তা জানেন নিমতিতার আলিনস্করপুরের বাসিন্দা জ্ঞানেন্দ্র বৈরাগী। তবু সিপিএমের উপর অটল বিশ্বাস ছিল এই বিষহরি শিল্পীর। এক বার পঞ্চায়েতে প্রার্থীও হয়েছেন। ভেবেছিলেন বিষহরির জনপ্রিয়তাই ভোটে উতরে দেবে। ভুল ভাঙে। প্রথম বারেই হোঁচট খেয়ে আর ও-মুখো হননি।
বিষহরির গান জ্ঞানেন্দ্রবাবুর রক্তে। এক কালে দাদু মোহিনীমোহনের বিষহরির গান শুনতে দূর-দুরান্ত থেকে ভেঙে পড়ত মানুষ। বাবা গোপীনাথও ছিলেন জাতশিল্পী। তাঁর কাছেই ছোটবেলায় গানের তালিম। জেঠুও ছিলেন নামজাদা গাইয়ে। ৬২ বছরের জ্ঞানেন্দ্রবাবু নিঃসন্তান। থাকেন এক ভাইপোর কাছে। এই বয়সেও বিষহরির ১১ জনের দল নিয়ে নেশার মত ছুটে বেড়ান ভিন্ জেলাতে। তাঁকে এক ডাকে চেনে এ তল্লাটে সকলেই।
জ্ঞানেন্দ্রেবাবুর কথায়, “এতেই আমি সার্থক। বেহুলা লখিন্দরের পালাগান শুনে আকুল নয়নে কাঁদতে দেখেছি শ্রোতাদের। কেউ কেউ আবার গলায় পড়িয়ে দিয়েছেন ফুলের মালা। এই তৃপ্তি... আজও ভুলতে পারি না।”
আগে এক-একটি গ্রামে ৭ থেকে ১০ দিন ধরে চলত গানের আসর। এখন সে কদর আর কই বিষহরির— গলায় ঝরে পড়ে একরাশ আক্ষেপ, “বিষহরি গাই শুধু রোজগারের জন্য নয়। তা ছাড়া ধর্মকথা শুনিয়ে শান্তির পথে, সততার পথে চলার বার্তা পৌঁছে দেওয়া যায় মানুষের কাছে। টিভিতে তো যা সব দেখায়। রাজনীতিতেও তারই ছোঁয়া। আমার বিশ্বাস লোকসংস্কৃতিই পারে সমাজকে হিংসামুক্ত করতে। কিন্তু সে ভাবে আর ডাক আসে কই। বহু দিন পরে ভোটের সময় কয়েক দিনের পালা আছে জালাদিপুরে।”
তা-ও গত কয়েকটা বছর ভোটের সময় একটু আধটু কাজ জুটত লোকশিল্পীদের। ভোট দিতে উৎসাহিত করা থেকে গণতন্ত্র সম্পর্কে আমজনতার সচেতনতা বাড়াতে সরকারি উদ্যোগে নানা অনুষ্ঠানে আয়োজন করা হতো মাঠে-ময়দানে। সরকারি প্রচারে লোকগানের জন্য ডাক পড়ত শিল্পীদের। এ বার কিন্তু তার ব্যতিক্রম ঘটেছে। ভোটের দিনক্ষণ ঘোষণার পর থেকে সরকারি নথিভুক্ত লোকশিল্পীরাও ডাক পাননি। আর খাতায় যাঁদের নাম নেই, তাঁরা তো ননই।
আগে বিভিন্ন দলের প্রার্থীরাও তাঁদের নিজেদের ভোট প্রচারে বাউল, কবিয়াল, বোলান শিল্পীদের গানের বরাত দিতেন। এ বার বদল এসেছে তাতেও। মুর্শিদাবাদ জেলা তথ্য ও সংস্কৃতি আধিকারিক সন্দীপকুমার পাল বলেন, ‘‘দফতরের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ থেকে শিল্পীদের দিয়ে লোকশিক্ষামূলক প্রচারের নির্দেশ আসে। সেই মতো লোকশিল্পীদের প্রচারে নিয়োগ করা হয়। এটাই দস্তুর। এ বছর সেই মতো গত ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত লোকশিল্পীরা গ্রামে গ্রামে সরকারি অনুষ্ঠান করেছেন। তার পর আর সরকারি নির্দেশ না থাকায় মার্চ মাসে লোকশিল্পীদের কোনও অনুষ্ঠান দেওয়া সম্ভব হয়নি।’’ কিন্তু কেন সরকারি ডাক এল না, তার কারণ অবশ্য সন্দীপবাবু ব্যাখ্যা করতে পারেননি। ওই দফতরের এক আধিকারিক বলেন, ‘‘ফেব্রয়ারি মাসে অনুষ্ঠান করে মার্চ মাস হতে চলেছে, শিল্পীরা তাঁদের পারিশ্রমিক পাননি। তাই ভোটের মাসে আর ঝুঁকি নেওয়া হয়নি।’’
সারা বাংলা লোকশিল্পী সংসদের সভাপতি দীপক বিশ্বাস বললেন, ‘‘কবিগান, বাউলগান, বোলানের মতো লোকজ গানের মাধ্যমে এক দিনে বড় জোড় ২-৩টি গ্রামের লোকশিক্ষা সম্ভব। গত কয়েক বছরের মধ্যে তথ্যপ্রযুক্তি বিজ্ঞানের উন্নতি হয়েছে রকেট গতিতে। হোয়াটস অ্যাপ, ফেসবুকের মতো সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে মুহূর্তে সব খবর ও ছবি পৌঁছে যাচ্ছে লক্ষ লক্ষ লোকের কাছে। আর গাঁ-গঞ্জের ঘরে ঘরেও এখন স্মার্টফোনের ছড়াছড়ি। ফলে সোশ্যাল মিড়িয়ার দৌলতে অল্প সময়ে এবং একই সঙ্গে স্বল্প খরচে সরকারি বা দলীয় প্রার্থীর প্রয়োজন মিটছে। তাই লোকশিল্পীদেরও কদর কমেছে।’’
এ তো গেল ভোটের গল্প, কিন্তু এই সব লোকশিল্পীরা তো ভোটারও বটে। এত নামিদামী শিল্পীর বরাতে কেন আজও সরকারি খয়রাতি জুটল না? কোনও বার্ধক্য ভাতাও হাতে পান না তাঁরা। কেন?
উত্তর জানা নেই। জ্ঞানেন্দ্রবাবুর ভাইপো হিমাংশুশেখর কাকার পথেই লোকগানে মজেছেন। কিন্তু তাঁর সাফ কথা “ আমার দুই ছেলেমেয়ে। দু’জনের কাউকেই আর এ পথে আনব না। এ পথে শুধুই কষ্ট। বাড়ির সকলে বিড়ি বেঁধে দু’বেলা পেট চলে যায়। ভোট আসে-যায়, আমাদের অবস্থা আজও সেই তিমিরেই।”
‘আল’ এবং ‘কাপ’ অর্থাৎ হাল্কা গ্রামীণ রসের গীতিধর্মী নাটক একসময় মুর্শিদাবাদে জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছেছিল। যুগের তালে নাম বদলে এখন তা বিবর্তিত হয়েছে পঞ্চরসে। মুর্শিদাবাদের আলকাপের শিল্পীদের মধ্যে অন্যতম মহাতাব। এখন ৭৫ ছাড়িয়েছে বয়স। সেই কবে ৯ বছর বয়সে ছোকড়া সেজে ঢুকেছিলেন গয়ানাথ ও সুবলের দলে। মেয়ে সেজে মাতিয়েছেন গ্রামীণ আসর। বিয়ে করেন আলকাপ দলেরই এক মহিলা শিল্পীকে। এক সময় নিজের দলও গড়েন। এখন সে সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার।
মহাতাবের আক্ষেপ, “আলকাপ এখন শেষ। কেউ বাজারে সব্জি বেচেন, নয়তো বা হকারি করেন। টিভি আর সিনেমার সিডি পৌঁছে গিয়েছে প্রত্যন্ত গ্রামেও। বিনোদনের রুচি বদলেছে মানুষের। কে আর আমাদের গান শুনবে।”
ধুলিয়ানের জাফরাবাদ গ্রামের বাউলশিল্পী নিমাই সরকার বাউল গান করেন। তাঁর স্ত্রী তাঁর স্ত্রী বাসন্তীদেবী করেন পালাকীর্তন। নিমাই বলছেন, “৫১ বছর বয়স হল। রেডিওতে গান গেয়েছি। বাউলের বোলের তালে মানুষকে নাচিয়েছি। আসরের মধ্যে টাকার মালা পড়িয়ে দিয়েছে অনেকে। প্রাপ্তি বলতে এই সম্মানটুকুই। এখন কবে একটা গানের ডাক আসবে সেই প্রতীক্ষায় হাপিত্যেশ করে বসে থাকা।’’
একটু থেমে ফের বললেন, ‘‘আর নয়, ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া শিখে কাজকর্ম করুক। এ পথে আর আনব না ওদের।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy