Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

বারুদ উদ্ধার উসকে দিল পিংলার স্মৃতি

সুতিতে বারুদের কারবার নতুন করে মাথা চাড়া দেওয়ায় সিঁদুরে মেঘ দেখছে পুলিশ। শনিবার পুলিশি অভিযানে একশো কিলোগ্রাম বারুদ উদ্ধারের ঘটনা উস্কে দিল পিংলা বিস্ফোরণের স্মৃতি।

নিজস্ব সংবাদদাতা
রঘুনাথগঞ্জ শেষ আপডেট: ১০ অগস্ট ২০১৫ ০০:৪২
Share: Save:

সুতিতে বারুদের কারবার নতুন করে মাথা চাড়া দেওয়ায় সিঁদুরে মেঘ দেখছে পুলিশ। শনিবার পুলিশি অভিযানে একশো কিলোগ্রাম বারুদ উদ্ধারের ঘটনা উস্কে দিল পিংলা বিস্ফোরণের স্মৃতি।

সুতিতে বোমা ও বারুদ উদ্ধারের ঘটনা নতুন নয়। বারুদের সঙ্গে সুতির কয়েকটি গ্রামের পরিচয় বহুদিনের। শুধু বয়স্ক পুরুষ মানুষই নয়, মহিলা-শিশুদের কাছেও এক সময় বারুদ ছিল জলভাত। সেই বারুদ দিয়ে তখন অবশ্য বোমা নয়, তৈরি হত বাজি। নতুন চাঁদরার বিপর্যয়ের পরে পুলিশের ধারণা ছিল সুতিতে বারুদের কারবার এ বার কিছুটা হলেও কমবে। সাময়িক ভাবে তাতে ভাটাও পড়েছিল। কিন্তু, তা যে পুরোপুরি বন্ধ হয়নি শনিবার নাটকীয় কায়দায় গাড়ি-সহ একশো কিলোগ্রাম বারুদ উদ্ধারের ঘটনা তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল।

বারুদ উদ্ধারের ঘটনাটিও রীতিমতো চমক লাগানোর মতো। কেমন?

এক লক্ষ চল্লিশ হাজার টাকায় রফা করে পরিচয় গোপন রেখে ক্রেতা সেজে পুলিশ শনিবার ভরদুপুরে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কে ডেকে এনে দুষ্কৃতীদের মাথায় রিভলভার ঠেকিয়ে অপহরণের কায়দায় গ্রেফতার করে সুতির বারুদের দুই কারবারিকে। তাদের কাছ থেকে একশো কিলোগ্রাম বারুদ সহ আটক করা হয় একটি নম্বর প্লেটহীন ছোটগাড়িও। এ দিনের সাদা পোশাকের এই অভিযানের কথা জানা ছিল না কারোরই। স্বাভাবিক ভাবেই দুই যুবকের মাথায় রিভলভার ঠেকিয়ে সাদা পোশাকের ৬-৭ জনের এ ভাবে ভরদুপুরে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের উপর থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনায় শোরগোল পড়ে যায় গোটা এলাকায়। অনেকেই সুতি থানায় ফোন করে অপহরণের ঘটনার কথাও জানায়। সুতি থানার পুলিশও রঘুনাথগঞ্জ থানার পুলিশের আগাম পরিকল্পনার কথা জানত না। স্বভাবতই বাসিন্দাদের টেলিফোন পেয়ে তারাও ধন্দে পড়ে। পরে অবশ্য বিভিন্ন সূত্রে সুতি থানার পুলিশ জানতে পারে বারুদের কারবারিদের ধরতেই ছক কষে রঘুনাথগঞ্জ থানার পুলিশের এই অভিযানের কথা।

এই বিস্ফোরক উদ্ধারের ঘটনায় রবিবার তদন্তে রঘুনাথগঞ্জ থানায় আসেন জেলার পুলিস সুপার সহ জেলা পুলিশের পদস্থ কর্তারা। ডেকে পাঠানো হয় সুতি থানার ওসি সুব্রত ঘোষকেও। ধৃতদের টানা ঘণ্টাখানেক ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করেন তাঁরা। রবিবারই তাদের জঙ্গিপুর আদালতে হাজির করা হলে আদালত পাঁচদিনের পুলিশ হেফাজতের নির্দেশ দেয়। ধৃতদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য এ দিন সন্ধ্যায় কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা সংস্থা ‘র’ এর তিন অফিসারও রঘুনাথগঞ্জ থানায় আসেন। পুলিশ সুপার সি সুধাকর বলেন, ‘‘একসঙ্গে ১০০ কিলোগ্রাম বিস্ফোরক পাওয়া গিয়েছে। তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সকলেরই বাড়ি সুতি থানা এলাকায়। সকলকেই জিজ্ঞাসাবাদ করে এলাকায় বারুদ আমদানির সোর্স জানার চেষ্টা হচ্ছে। এই এলাকায় বারুদ বা বোমা উদ্ধারের ঘটনা এর আগেও ঘটেছে। প্রাথমিক তদন্তে মনে হয়েছে, দেশের নিরাপত্তা বিপন্ন হওয়ার মতো বড় কিছু নেই এই ঘটনায়।’’ জেলা পুলিশের এক আধিকারিক বলেন, ‘‘ বিস্ফোরক উদ্ধারের ঘটনা সুতি ও রঘুনাথগঞ্জে নতুন কিছু নয়। তবু সীমান্ত এলাকা বলে ধৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ করে নিরাপত্তা জনিত কোনও সমস্যা আছে কি না তা সুনিশ্চিত হতে চাইছি।’’

কিন্তু কেন এত বারুদের রমরমা সুতিতে? এক সময় অরঙ্গাবাদের তৈরি বাজির রাজ্য জোড়া সুনাম ছিল। সুতিতে বারুদের আমদানি ও কারবার ফুলে ফেঁপে ওঠে মূলত সেই বাজির হাত ধরেই। ঝাউ, কদম্ব, কালেন্ডার, ঝর্না, এয়ার ফাইটার, শিপ, কাদম্বিনি হরেকরকম নামের সব বাজি। অরঙ্গাবাদ থেকে যেত রাজ্যের বিভিন্ন বাজারে। বিশেষ করে বিয়ে, পৈতে, অন্নপ্রাশন বা যে কোনও পুজো বা উৎসব অনুষ্ঠানে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে বাজির প্যাকেজের বায়না দিলে অরঙ্গাবাদের বাজি কারিগররাই বাজি নিয়ে হাজির হতেন বাড়িতে। দুপুর থেকেই বাঁশ বেঁধে সাজানো হত বাজি ফাটানোর মঞ্চ।

সন্ধ্যে নামতে বাজিতে আগুন দিতেন তাঁরাই। রাতের আধাঁরে বাজির রোশনাই দেখতে ভিড় জমত গ্রামের মানুষের। শব্দ বাজি নয়, বিন্দু বিন্দু আলোর রোশনাই কখনও মালা বদলরত রমণীর সাজে আকাশ থেকে নেমে আসত, কখনওবা সানাই সহ বাজনদারের মূর্তি ভেসে উঠত রাতের আকাশে। অরঙ্গাবাদের সেই বাজির কেরামতির দিন এখন ফুরিয়েছে। সেই ঐতিহ্য কিছুটা হলেও আঁকড়ে ছিল নতুন চাঁদরা ও দারিয়াপুর। কিন্তু পুলিশের উপর হামলাই কাল হয়েছিল ওদের। অরঙ্গাবাদ লাগোয়া পাশের এক গ্রামে দুই গোষ্ঠীর বোমাবাজি থামাতে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছিলেন সুতি থানার তৎকালীন ওসি সুরজিত সাধুখাঁ। আর তার জেরেই সুতির গ্রামগুলিতে বারুদের কারবার বন্ধ করতে উঠেপড়ে লাগে পুলিশ। তার জেরে বন্ধ হয়ে যায় নতুন চাঁদরার সমস্ত বাজি কারখানাও।

বাজির কারবার বন্ধ হলেও বারুদের সঙ্গে সম্পর্ক আজও ভাঙতে পারা যায়নি সুতির গ্রামগুলির। নতুন চাঁদরাকেই কেউ কেউ ডাকেন জয়বাংলা নামে। পঞ্চাশোর্ধ কলিমুদ্দিন শেখ বলেন, ‘‘ছোট বেলা থেকেই বাজির কারবার দেখে আসছি আমরা। বাবা ছিলেন বাজির যাদুগর। বিয়ের মরসুমে ও পুজোর মাসে নাওয়া খাওয়ার সময় থাকত না কারুরই। বাড়ির শিশু, কিশোর, মেয়েরাও সমানে হাত লাগাত বাজি তৈরিতে। উঠোন ছিল না কোনো বাড়িতেই। তাই বাইরের রাস্তা জুড়ে রৌদ্রে দিনভর শুকোনো হত সে বাজি খেঁজুর বা তালের পাটিতে। বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত লেবেল সেঁটে তা প্যাকেটে ভরত শিশু ও মেয়েরা। বাজির গায়ে সে ভাবে লেবেলের চটকদারি না থাকলেও নতুন চাঁদরা ও দারিয়াপুরে বাজির কারবারিদের বাড়ি চিনে ক্রেতাদের গ্রামে চলে আসতে কোনও অসুবিধে হত না। বহুবার বহু বিয়ে বাড়িতে গিয়ে নিজের হাতে সন্ধ্যে রাতে বাজি ফাটিয়ে গভীর রাতে ট্রেন ধরেই বাড়ি ফিরেছি আমরা।’’ এখন সেই বাজিই যেন কাল হয়েছে অরঙ্গাবাদবাসীর কাছে।

পুলিশ জানাচ্ছে, বাজি বদলে গিয়েছে বোমায়। বাজির নামে বারুদ ও মশলা এনে বোমা গড়ছে দুষ্কৃতীরা। ওই কাজে যুক্ত লোকজন বলছেন, ‘‘বাজি গড়ে আগে ইনাম পেতাম। এখন বোমা গড়ে কেউ মানুষ মারছে, কেউ জেলে যাচ্ছে। তাই বেড়েছে পুলিশি উৎপাতও। বাজি তৈরির নামে বারুদ এনে বোমা তৈরি হচ্ছে পাশের বাগানে। বোমা যেন এখন কুটির শিল্প হয়ে উঠেছে আশপাশের কয়েকটি গ্রামের।’’ ফলে বাজি তৈরির পাট তুলে দিতে হয়েছে নতুন চাঁদরা ও দারিয়াপুরকে।

এলাকার এক প্রবীণ রবিউল ইসলাম বলছেন, ‘১৯৮২ সাল পর্যন্ত এখানে লাইসেন্স দেওয়া হত বাজির কারবারিদের। শিবকাশি বা বুড়িমার বাজি তখন কোথায় ? তবে বাড়ির ৮- ১০ বছরের শিশুদের বাজি তৈরির কাজে কখনও লাগানো হত না। তারা বাজিতে রঙীন কাগজের মোড়ক লাগাত আর বাজি তৈরির পর তা রোদে শুকোতে দেওয়ার কাজ করত।’’ বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, দুই গ্রামে তখন বসতি বলতে বড়জোর দু’শো ঘর। অরঙ্গাবাদের বাজির রমরমা বাজার ছিল তখন নতুন চাঁদরায়। দু’হাতে টাকা আসত। কেউ বেকার বসে থাকতেন না গ্রামে। কোন পটকায় কী ভাবে ও কতটা মশলা দিতে হবে, বাড়ির শিশু, কিশোরেরাও তা বলে দিতে পারত। তারপর সরকার থেকে বাজি তৈরির লাইসেন্স দেওয়া বন্ধ হয়ে গেল।

গ্রামের কয়েকজন স্বীকার করেছেন, তারপরেও বাজি তৈরি পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। পুলিশকে পয়সা দিয়ে সেদিন পর্যন্তও বাজি তৈরি হয়েছে দুই গ্রামেই। তবে কিছুটা লুকিয়ে চুরিয়ে। পুলিশ থেকে রাজনীতিক সবাই জানে এই বাজির কারবারের কথা। খদ্দেরও আসত গ্রামে। উৎসব অনুষ্ঠানে তাঁরা পৌঁছে যেতেন। জেলার থানাগুলির কালী পুজোর উৎসবে গত বছরও যে সব বাজি ফাটানো হয়েছে তার জোগান দিয়েছে অরঙ্গাবাদ, এমনই দাবি বাসিন্দাদের। পুজোর দু’-তিন মাস আগে থেকেই ব্যস্ত থাকত গোটা গ্রাম। এভাবেই চলছিল কারবার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Explosive Suti rajhunathganj murshidabad
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE