যাত্রীর অপেক্ষায় মাঝি। নবদ্বীপে তোলা নিজস্ব চিত্র।
নদীর ঘাটের কাছে নৌকা বাঁধা থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বানভাসি নবদ্বীপে এখন পাড়ার মোড়ে রিকশা কিংবা টোটো নয়, বাঁধা থাকছে নৌকা। শহর নবদ্বীপের ছবিটা আমূল বদলে দিয়েছে বন্যা। চৈতন্যধামের রাজপথ থেকে তস্য গলিতে প্রবাহিত হচ্ছে গঙ্গার ঘোলা জল। ভক্ত-পর্যটকদের প্রিয় গন্তব্য উৎসব নগরীতে এখন ভেনিসের আদল। চারদিকে জল আর জল দেখে স্থানীয় বাসিন্দাদের ‘চিত্ত বিকল’ হওয়ার জোগাড়। নবদ্বীপের চেনা রাস্তাগুলোর বেশিরভাগই বেশ কয়েক বছর পর ফের ডুব দিয়েছে গঙ্গার ঘোলাটে জলে। পথই যখন উধাও তখন উপচে পড়া ভিড়ও নেই। নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া জল ভেঙে আর কে বের হতে চায়! ফলে বন্যার সৌজন্যে নবদ্বীপের সেই চেনা যানজট বিলকুল উধাও।
ভরসা নৌকা
বেপরোয়া বাইকের দৌরাত্ম্য নেই। থেমেছে নিয়মের তোয়াক্কা না করা টোটোর সেই দাপাদাপি। সবার আগে যেতে চাওয়া সাইকেল তোলা আছে ঘরের উঁচু কোনও জায়গায়। প্লাবিত নবদ্বীপের যে কোনও প্রান্তে যেতে হলে নৌকোযাত্রা ছাড়া কোন গতি নেই। নবদ্বীপের চেনা তেমাথা বা পাঁচ মাথার মোড়ের চেনা রিকশা বা টোটোস্ট্যান্ড রাতারাতি বদলে গিয়েছে খেয়াঘাটে। আর সেই সব নতুন নতুন ঘাট থেকে শহরের হাসপাতাল, চৈতন্যদেবের জন্মস্থান-সহ বিভিন্ন জায়গায় যাতায়াত চলছে নৌকা করে। ভাড়া দুরত্ব বুঝে। কোথাও দশ টাকা তো কোথাও কুড়ি কিংবা ত্রিশ। এমনকী বন্যা দেখাতে ‘কন্ডাক্টেড ট্যুর’—এর ব্যবস্থাও আছে। বিকেলের দিকে একঘণ্টায় নৌকা চেপে বন্যা দেখার খরচ পড়ছে একশো টাকা। ভিড় হচ্ছে ভালই। সব মিলিয়ে এখন শহর শাসন করছে নৌকা।
ব্যস্ত মাঝি
ঘাটের নাম কপালিপাড়া। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এখন শহরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খেয়াঘাট। এখান থেকেই নবদ্বীপ স্টেট জেনারেল হাসপাতাল-সহ প্রতাপনগরের বিস্তীর্ণ এলাকায় যাওয়ার নৌকা ছাড়ছে। একই সঙ্গে চৈতন্যদেবের জন্মস্থান আশ্রম-সহ নবদ্বীপের উত্তর দিকে প্রাচীন মায়াপুরের বিভিন্ন এলাকায় যাওয়ার নৌকা মিলবে ওই কপালিপাড়ার মোড় থেকেই। হাসপাতাল হোক কিংবা চৈতন্যদেবের জন্মস্থান—কপালিপাড়া মোড়ে নৌকা সবসময় তৈরি। ভাড়া দশ থেকে কুড়ি টাকা। নবদ্বীপের পশ্চিমে বাবলারি পঞ্চায়েত এলাকায় যেতে হলে আবার আসতে হবে মালঞ্চপাড়ার গাবতলায়। সেখান থেকে একই ভাবে ছাড়ছে নৌকা। এক্ষেত্রে গন্তব্যের দুরত্ব বেশি বলে ভাড়া কুড়ি থেকে ত্রিশ টাকার মধ্যে ঘোরাফেরা করছে। শহরের দক্ষিণ প্রান্তে কোলেরডাঙা, প্রফুল্লনগর, হরিতলার দিকে অবশ্য এই ‘নৌকা সার্ভিস’ ততটা সুলভ নয়। ফলে যাতায়াতে অনেক বেশি সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে ওই এলাকার বাসিন্দাদের।
জরুরি সঙ্গী
বন্যার হিড়িকে নৌকা তৈরি কিংবা মেরামতির ধুম লেগেছে নবদ্বীপ জুড়ে। এমনিতেই বন্যাপ্রবণ এলাকায় বহু মানুষের বাড়িতেই নিজস্ব নৌকা থাকেই। নবদ্বীপের নীচু অঞ্চলের খোঁজ করলে অনেকের বাড়িতেই ছোট, মাঝারি সাইজের নৌকা পাওয়া যাবে। কিন্তু টানা বছর আটেক বন্যা না হওয়ায় সেই সব নৌকার বেশির ভাগই নষ্ট হয়ে গিয়েছে। এ বছর ফের বন্যা দেখা দেওয়ায় আবার রাতারাতি নৌকা তৈরির ব্যস্ততা চোখে পড়ছে। শহরের রানিরঘাট, উডবার্ন রোড এবং গাবতলা দাসপাড়া এই তিনটি জায়গা মিলিয়ে গত এক সপ্তাহে কম করে শ’দুয়েক নৌকা তৈরি হয়েছে।
গত ২ অগস্ট বন্যার মধ্যেই হরিতলার বাসিন্দা অসীম ঘোষের মা মারা যান। পারলৌকিক কাজের সুবিধার জন্য নিরুপায় অসীমবাবু আড়াই হাজার টাকা দিয়ে তৈরি করিয়েছেন ছোট একটি নৌকা। আবার নবদ্বীপ বড় বাজারের ব্যবসায়ী কার্তিক দেবনাথের প্রতাপনগরের বাড়িতে একগলা জল। ৪৮০০ টাকা দিয়ে কার্তিকবাবুও তৈরি করিয়েছেন মাঝারি মাপের নৌকা। তাঁর কথায়, “ওই জলের মধ্যে যাতায়াত করা ছাড়াও পানীয় জল, ওষুধপত্র আনা কিংবা আশপাশের কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে হাসপাতাল নিয়ে যাওয়া সবকিছুই সুবিধা হয় নিজের নৌকা থাকলে।”
জলেও পুলিশ
নবদ্বীপের প্রবীণ কাঠ ব্যবসায়ী তপন মুখোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘ডিঙি বলে পরিচিত নানা আকারের ছোট নৌকা তৈরির জন্য দক্ষ কারিগরের প্রয়োজন হয়। যে কোনও কাঠমিস্ত্রি নৌকা তৈরি করতে পারেন না। কাঠও আলাদা।’’ তিনি জানান, প্রধানত পেও কাঠেই এই ধরনের নৌকা সবচেয়ে ভাল হয়। তবে জিউলি এবং লম্বু কাঠও নৌকা তৈরিতে কাজে লাগে। দাসপাড়ায় নৌকা তৈরি করছিলেন উত্তম রায়। খুব দ্রুত হাত চালাতে চালাতে বলেন, “এই কাজ করতে হয় খুব দ্রত। কাঠ, মিস্ত্রি সবই সঙ্গে সঙ্গে জোগাড় করতে হয়। টিন, কাঠ এবং মজুরি মিলিয়ে নৌকার দাম ঠিক হয়।”
কেমন দাম পড়ছে এক একটি নৌকার? রানিরঘাটের আনন্দ শর্মা জানান, দু’হাজার থেকে থেকে দাম শুরু। একটি মাত্র টিন আর সামান্য কাঠ দিয়ে তৈরি ডিঙির দাম সব থেকে কম। খুব দক্ষ না হলে চালানো মুশকিল। তবে অসম্ভব দ্রুত ছোটে এই ডিঙি। আর তিন দিক কাঠ দিয়ে ঘেরা ও নীচে টিন দেওয়া নৌকার দাম পড়ে পাঁচ হাজারের কাছাকাছি। এগুলি প্রায় ছ’জন লোক বহন করতে পারে। আর দুদিক ছুঁচলো সম্পূর্ণ কাঠের নৌকা তৈরি করলে খরচ পড়ে প্রায় ষোলো থেকে আঠারো হাজার টাকার মতো।
তবে তারক শর্মা, টোটোন শর্মারা জানান, ওই নৌকা তৈরি করতে প্রচুর সময় লাগে। লাগে শাল কাঠ। বন্যার প্রয়োজন মেটাতে সাধারণত ওই নৌকা কেউ বানায় না। একজন দক্ষ কারিগর এবং দু’জন মিস্ত্রি মিলে এক একটি নৌকা গড়তে মাথা পিছু চার থেকে পাঁচশো টাকা মজুরি পান।
পুলিশ জানিয়েছে, নবদ্বীপের বিভিন্ন এলাকা নৌকায় টহল দেওয়া হচ্ছে। এই সময় কোথাও যাতে কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে সে ব্যাপারে পুলিশ কড়া নজর রাখছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy