Advertisement
E-Paper

ফ্লাড শেল্টারের স্কুলে বুক ভরে গেছে চরযাত্রাসিদ্ধির

চরযাত্রাসিদ্ধি কাঁচা রাস্তার উপরে আলগোছে পাতা ইটের উপরে আলগাভাবে ছড়ানো সিমেন্টের গোলা— উন্নয়নের রাস্তা। সেই রাস্তা দিয়ে হোঁচট না খেয়ে এগনো বেশ কঠিণ। সামনে জবরজং একটা কাঠের সেতু। উন্নয়নের সেখানেই ইতি। তার পরেই অপেক্ষা করে আছে ‘নেই জেলা’র গ্রাম চরযাত্রাসিদ্ধি। বছর কয়েক আগেও তাদের পরিচয় হুগলি-নদিয়ার ঠেলাঠেলির বিরাম ছিল না।

সুপ্রকাশ মণ্ডল

শেষ আপডেট: ২৯ মার্চ ২০১৬ ০১:৫৮

চরযাত্রাসিদ্ধি

কাঁচা রাস্তার উপরে আলগোছে পাতা ইটের উপরে আলগাভাবে ছড়ানো সিমেন্টের গোলা— উন্নয়নের রাস্তা। সেই রাস্তা দিয়ে হোঁচট না খেয়ে এগনো বেশ কঠিণ। সামনে জবরজং একটা কাঠের সেতু। উন্নয়নের সেখানেই ইতি। তার পরেই অপেক্ষা করে আছে ‘নেই জেলা’র গ্রাম চরযাত্রাসিদ্ধি। বছর কয়েক আগেও তাদের পরিচয় হুগলি-নদিয়ার ঠেলাঠেলির বিরাম ছিল না। সে সমস্যা মিটেছে। গত ছ’বছরে তিন-তিনটে ভোট দিয়ে দিয়ে নদীর কোলে জল ছপছপে গ্রামটা বলছে— এখন আমরা সাবালক, ভোট দিতে পারি। গণতন্ত্রের কালি বার কয়েক নখে লাগালেও মাথা নীচু করে গ্রামের প্রবীণ মতিলাল জানাচ্ছেন, ‘‘লেকিন উন লোগ তো আতা নেহি।’’ এমনকী, স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্যকেও ভোটের পরে দেখেননি তাঁরা। নেতাদের এমন কাণ্ড লজ্জিত করেছে এক সময়ের প্রান্তিক বিহারের বাসিন্দা খেটে খাওয়া, ছা-পোষা এই দেহাতি মানুষগুলিকে। চড়া রোদে মকাইয়ের জমিতে দাঁড়ানো বৃদ্ধ লছমন মাহাতোর প্রশ্ন, ‘‘ইসি কা নাম জনগণ কি সরকার?’’

কল্যাণী শহরের কেন্দ্রস্থল থেকে মেরেকেটে আট কিলোমিটার দূরে চরযাত্রাসিদ্ধি। চরযদুবাটি থেকে কাঠের সেতু পেরিয়ে এ গ্রামে এলে চকিতে মনে হবে বিহারের পূর্ণিয়ার কোনও গ্রামে বুঝি এসে পড়েছেন। মাচার উপরে বা বড় গাছের তলায় বসে দেহাতি মানুষদের সেই অলস আড্ডায় চড়া গলায় ভোজপুরি ভাষায় কথন। মনে হবে, এই বুঝি সতীনাথ ভাদুরীর সেই ঢোড়াই-এর গ্রাম। রাস্তার বিদ্যুতের খুঁটিগুলিই যা বেমানান। তা না হলে সময়টাও বুঝি সেই ঢোড়াই চরিত মানসের সময়েই থেমে রয়েছে। এখানে উন্নয়নের মানে, গ্রামের মুদিখানা দোকানে বহুজাতিক কোম্পানির ‘পটাটো চিপস’।

উনিশ শতকের তিনের দশকে বিহারের পূর্ণিয়া, ভাগলপুর-সহ আশপাশের এলাকা থেকে প্রচুর মানুষ গঙ্গার চরগুলিতে বসবাস শুরু করেন। চরসরাটি, চরযদুবাটি, চরযাত্রাসিদ্ধি গ্রামগুলিতে এদের অন্যতম। অন্য চরগুলির বাসিন্দারা অনেক আগে থেকেই ভোটাধিকার পেয়ে গিয়েছেন। বাকি ছিল যাত্রাসিদ্ধির বাসিন্দারা। হুগলি না নদিয়া, তাঁরা কোন জেলার বাসিন্দা, তা ঠিক করতেই প্রশাসনের কেটে গিয়েছিল কয়েক দশক। অবশেষে ২০০৯ সালে লোকসভা ভোটে সেই সমস্যা মেটে। আর কিছু না মিটুক, নদিয়া জেলার বাসিন্দা হিসবেই ভোটের সচিত্র পরিচয়পত্র এসেছে গ্রামে।

‘‘শুধু বিদ্যুতের কথা বললে গ্রামের উন্নয়নকে খাটো করা যাবে না’’''।, বলেই ফিক করে হেসে ফেলেন মাঝবয়েসি দশরথ মাহাতো। গ্রামের এক মাত্র প্রাইমারি স্কুলের চত্বরে অলস দুপুরে অনেকের সঙ্গে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছিলেন তিনি। বললেন, ‘‘দেখছেন না গ্রামে স্কুল রয়েছে।’’ গোপীনাথ জানাচ্ছেন, আসলে ফি বর্ষায় বন্যায় সব ধুয়ে যায় তাই একটা ফ্লাড সেন্টার তৈরি করা হয়েছিল। সেটাই এখন প্রাথমিক স্কুল।

গ্রামের পঞ্চায়েত সদস্য কে? সমস্বর উত্তর দিল, শিবশঙ্কর মাষ্টার। হ্যাঁ ডি ফ্যাক্টো পঞ্চায়েত সদস্য তিনিই। আদতে ভোটে জিতে জয়ী হয়েছেন তাঁর বৌদি হৈমন্তী। কিন্তু, ‘পড়া লিখা’ না জানা হৈমন্তী আবার সদস্য কী! অতএব কোনও এক সময়ে কলেজে পড়া শিবশঙ্করই মাস্টারই গ্রামের ‘সদস্য’। মাষ্টারজিকে অবশ্য পাওয়া গেল না। দশরথ মাহাতরা জানালেন, গত পঞ্চায়েত ভোটের পর থেকেই শিবশঙ্কর বাইরে থাকেন। গ্রামের মানুষের খোঁজখবর নেওয়া তার বিষয় নয়। হৈমন্তি বললেন, ‘‘আমি পঞ্চায়েতের কিছু জানি না। সব দেওরই করে। কত নম্বর বুথের সদস্য তিনি, তাও জানি না। তবে হ্যাঁ আপ পানি চাহে তো দে সকতা হ্যায়।’’ তবে, চড়া গলায় গ্রামে উন্নয়নের সওয়াল করছেন তিনি। উঠোনের ভিড়টা একসঙ্গে প্রতিবাদ করে— ‘‘সে রাস্তা তো তৈরির এক মাসের মধ্যেই ছাতুফুটো হয়ে গিয়েছে।’’' হৈমন্তির উত্তর, ‘‘ভাঙলে তবেই না নতুন হবে।’’ ভিড় বলল, ‘‘ইয়ে সহি হ্যায়।’’

ভোট যে এসেছে, তা জানান দিচ্ছে দেহাতি মানুষদের নিকানো দেওয়াল। সেখানে তৃণমূল প্রার্থীকে পুননির্বাচিত করার আবেদন। উপেন মাহাত জানালেন, গ্রামে সব পার্টিই এখন ভোট চাইতে আসে। ভোট আসে, ভোট যায়। কিন্তু এই গ্রামের কোনও উন্নয়ন হয় না। তিনি বলছেন, ''এই যে দেখছেন, যদুবাটির রাস্তা সিমেন্টের হল। একে কী রাস্তা বলে। কটা ইট পেতে তার উপরে কোনও রকমে সিমেন্ট গুলে ঢেলে দেওয়া হয়েছে। দু'সপ্তাহ আগের তৈরি রাস্তা। কিন্তু এরই মধ্যে ভাঙতে শুরু করেছে। ভোটের আগে রাস্তা তৈরির মানে কি আর আমরা বুঝি না।''

সামান্য নুন আনতে এখনও এই গ্রামের বাসিন্দাদের গঙ্গা পার হয়ে যেতে হয় হুগলির চন্দ্রহাটি। স্কুল কলেজও সেখানেই। ফলে প্রাইমারি স্কুল ছাড়িয়ে গ্রামের অধিকাংশ মেয়েদের আর শহরের স্কুল যাওয়া হয় না। আর বর্ষার সময় ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে স্কুল বন্ধ। কারণ, অধিকাংশ সময়ই গ্রাম থাকে জলের তলায়। নদিয়া নির্মল জেলা বলে, প্রশাসন সেই দিল্লি গিয়ে পুরষ্কার নিয়ে এসেছে। কিন্তু গ্রামের অধিকাংশ ঘরেই নেই শৌচাগার। কয়েকটি অবশ্য কাঠামো নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বাসুদেব মাহাত জানালেন, ‘‘মাঝপথে কাজ বন্ধ করে চলে গিয়েছে ঠিকাদাররা।’’

গ্রামের এক যুবক মুচকি হাসেন, আর আসে। ‘‘এক বার যো ইঁহা সে নিকালতা হ্যায় উও লৌটতা নেহি!’’ নদী পাড়ে তাই একা একাই পড়ে তাকে চরযাত্রাসিদ্ধি।

flood
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy