Advertisement
১১ জুন ২০২৪

নবদ্বীপ এখন ঝুলনের সাজে, টানা ছুটিতে গেস্টহাউস ফুল

চৈতন্য জীবনীকার বৃন্দাবন দাস তাঁর চৈতন্য ভাগবতে লিখেছিলেন, ‘অদ্যপি সেই লীলা করে গোরা রায়, কোন কোন ভাগ্যবানে দেখিবারে পায়।’ চৈতন্যধামে তাঁর লীলাসঙ্গী হওয়ার বাসনায় পৃথিবীর নানাপ্রান্ত থেকে সারা বছর ধরে নবদ্বীপে ছুটে আসেন ভক্তের দল।

মোহান্তবাড়িতে চলছে ঝুলনের প্রস্তুতি। — নিজস্ব চিত্র

মোহান্তবাড়িতে চলছে ঝুলনের প্রস্তুতি। — নিজস্ব চিত্র

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়
নবদ্বীপ শেষ আপডেট: ১২ অগস্ট ২০১৬ ০১:১৩
Share: Save:

চৈতন্য জীবনীকার বৃন্দাবন দাস তাঁর চৈতন্য ভাগবতে লিখেছিলেন, ‘অদ্যপি সেই লীলা করে গোরা রায়, কোন কোন ভাগ্যবানে দেখিবারে পায়।’ চৈতন্যধামে তাঁর লীলাসঙ্গী হওয়ার বাসনায় পৃথিবীর নানাপ্রান্ত থেকে সারা বছর ধরে নবদ্বীপে ছুটে আসেন ভক্তের দল। আর ভক্তের সঙ্গে ভগবান যেখানে মিলিত হন সেখানেই জন্ম নেয় উৎসব। ফলে তেরো পার্বণের দেশ নবদ্বীপে গঙ্গার পূর্ব-পশ্চিম দু’পাড় জুড়ে আক্ষরিক অর্থেই বারো মাসই উৎসবময়।

তাঁতশিল্প ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর নবদ্বীপের অর্থনীতি এখন পর্যটনের উপরই নির্ভরশীল। তাই সারা বছর কোনও না কোনও উৎসবের চাদরে নিজেকে মুড়ে রাখে নবদ্বীপ। রাস বা দোলের মতো না হলেও শ্রাবণ-ভাদ্রে জন্মাষ্টমী, নন্দোৎসব কিংবা ঝুলনের মতো উৎসবের টানেও এখন দেশ-বিদেশ থেকে ছুটে আসেন ভক্ত-পর্যটকের দল। ভরা বর্ষার মন্দা মরশুমেও স্থানীয় বানিজ্যের শ্রীবৃদ্ধি ঘটে। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বলেন ঝুলন হল নবদ্বীপের প্রাক-শারদীয়া মহড়া। তাই ঝুলন উৎসবের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত এখন নবদ্বীপ-মায়াপুর।

উৎসবের ভাবনা থেকে উদযাপন। সব ক্ষেত্রেই নবদ্বীপের ঝুলন ভিন্নতর মেজাজের উৎসব। ক্যালেন্ডারের পাতায় অথবা পঞ্জিকার হিসেবে ঝুলন পাঁচ দিনের উৎসব। কিন্তু প্রচলিত প্রথা মেনে উৎসব শুরু হয়ে যায় শ্রাবনের শুক্লা প্রতিপদ থেকেই। ধামেশ্বর মহাপ্রভু মন্দিরের ঝুলনের উৎসব চলে পক্ষকাল জুড়ে। প্রবীণ গোস্বামীদের মতে আদতে ঝুলন হল ব্রজমণ্ডলের উৎসব। বর্ষাঋতুতে বৃন্দাবনে রাধাকৃষ্ণের ঝুলন পরবর্তী কালে গৌরমণ্ডলেও পালন করা শুরু হয়। তবে অন্য ভাবে।

বলা হয়, মহাপ্রভু হলেন রাধাকৃষ্ণের মিলিত তনু। রাধাকৃষ্ণের নিত্যলীলা তাঁর মাধ্যমে নবদ্বীপে নতুন করে রূপ লাভ করেছিল। তাই নবদ্বীপ গুপ্ত বৃন্দাবন। এখানে ঝুলন তাই রাধাকৃষ্ণের নয় মহাপ্রভুর। স্মরণে রেখে নবদ্বীপে ঝুলন উৎসব মূলত শ্রীচৈতন্য কেন্দ্রিক।”

সত্যিই উদ্‌যাপনের রীতি প্রকরণে নবদ্বীপের ঝুলনের সঙ্গে ভূ-ভারতে আর কোথাও মেলে না। সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ধারায় ঝুলন হয় নবদ্বীপের বিভিন্ন মঠমন্দিরে। মহাপ্রভু মন্দিরে মহাপ্রভুর সেই প্রাচীনতম বিগ্রহকে ঝুলনের শেষ পাঁচদিন পাঁচটি ভিন্ন বেশে সাজানো হয়। বিপুল অলংকারে সাজানো হয় বিগ্রহ। মন্দিরের এক সেবাইত প্রদীপকুমার গোস্বামী বলেন, “মহাপ্রভুকে একাদশীতে নটবর, দ্বাদশীর দিন রাজনটবর, ত্রয়োদশীর দিন রাখাল, চতুর্দশীতে নাগরী বেশ এবং পূর্ণিমাতে রাজবেশে সাজানো হয়।” নবদ্বীপের হরিসভা মন্দিরে অন্যতম প্রাচীন গৌরাঙ্গ মূর্তি ‘নাটুয়া গৌর’কে ঝুলনের শেষ পাঁচ দিন সাজানো হয় পাঁচটি বিশেষ বেশে। তবে মহাপ্রভু মন্দিরের পাঁচ দিনের সাজসজ্জার সঙ্গে হরিসভা মন্দিরে নাটুয়া গৌরের বেশের কিছু রকমফের আছে। আবার প্রাচীনমায়াপুরে চৈতন্য জন্মস্থান আশ্রমেও একই ভাবে পাঁচদিন ধরে মহাপ্রভুর ঝুলন হয়। সমাজবাড়ির গোবিন্দবাড়ি, বলদেব বাড়ি, গোরাচাঁদের আখড়া, রাধা মদনমোহন মন্দির, মোহন্তবাড়ি, জন্মস্থান আশ্রমে পাঁচদিন ধরে ঝুলন হয়।

এই ঝুলনের স্বাদ নিতেই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আকাশ ভাঙ্গা বৃষ্টি মাথায় নিয়েও মানুষের ঢল নামে নবদ্বীপ মায়াপুরে। অন্যদিকে বিভিন্ন ক্লাবের উদ্যোগে মানুষ ঝুলনকে ঘিরে মেলার চেহারা নেয় নবদ্বীপের গঙ্গার ঘাটগুলি। সেখানে আবার মুখ্য হয়ে ওঠে নানা পৌরাণিক কাহিনির আশ্রয়ে স্বল্প সময়ের অভিনয়।

এ বারে ঝুলনের শুরু সপ্তাহের শেষ দিন অর্থাৎ শনিবার। সোমবার স্বাধীনতা দিবসের ছুটি। টানা তিন দিনের ছুটির প্যাকেজে ইতিমধ্যেই ঠাই নাই রব। তার পরেও বুধবার মনসা পুজো, বৃহস্পতিবার রাখী পূর্ণিমা। গোটা সপ্তাহ জুড়েই কেমন ছুটির পরিবেশ। ফলে মায়াপুর ইস্কনের গেস্ট হাউস হাউসফুল। ইস্কনের রমেশ দাস জানালেন, এক মাস আগেই বুক হয়ে গিয়েছে সব ক’টি গেস্টহাউস। চার হাজার শয্যা বিশিষ্ট ইস্কনের অতিথিশালা ভর্তি হওয়ার পরে অন্যান্য মঠমন্দির এবং হোটেলেও একই অবস্থা।

ছবিটা একই রকম নবদ্বীপেও। নবদ্বীপের বিভিন্ন মঠমন্দিরে চলছে ঝুলনের প্রস্তুতি। মোহান্ত বাড়ি, বলদেব বাড়ি, মদনমোহন মন্দির, নতুন মন্দির, গোরাচাঁদের আখড়া যুদ্ধকালীন তৎপরতা। মোহান্ত বাড়ির বর্তমান সেবাইত বাবু মোহান্ত জানান, এ বারের তাঁদের ঝুলনের ‘থিম’ চৈতন্যদেবের কাজী উদ্ধার এবং কুষ্ঠ উদ্ধার। নাটমন্দির সাজবে পাহাড়ে ধ্যানরত দ্বাদশ ঋষির মূর্তিতে। বলদেব মন্দিরে ঝুলনে বলদেবের জিউর আবির্ভাব তিথি উদযাপন হয়।

মণ্ডপ থেকে মৃৎশিল্পী, আলোক সজ্জা থেকে ফুলের বিপুল ব্যবহার হয় ঝুলনে। বড় বড় মন্দিরে ব্যয় হয় লক্ষাধিক টাকা। নেহাত ছোট মন্দিরের বাজেটও বিশ-পঁচিশ হাজার টাকা। দিনে দিনে লোক সমাগমের সঙ্গে বাড়ছে মন্দিরের ঝুলনের রমরমা। নবদ্বীপ ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক নিরঞ্জন দাস বলেন, ‘‘ঝুলন এখন নবদ্বীপের পুজোর শুভারম্ভ বলতে পারেন। নবদ্বীপের প্রাক শারদীয়া।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Jhulan nabadwip
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE