কথা বলতে বলতে স্মৃতিমেদুর হয়ে পড়ছিলেন নারায়ণ সান্যাল। তখন এক দিন ছিল বটে! বিজয়ার প্রণাম করে বসে পড়তেন দাওয়ায়। আর মাসিমা, কাকিমা, পিসিমনিদের দিকে তাকিয়ে এক মুচকি হাসি। হাসির আড়ালে থাকা ইচ্ছেটুকু ঠিক ধরে ফেলতেন তাঁরা। খানিক পরে বাড়ির ভেতর থেকে আসত কাঁসার গ্লাসে ঠান্ডা জল আর বাটিতে সাজানো নারকেল নাড়ু, তিলের নাড়ু, ঝোলার ঝুরির নাড়ু। মুড়ি-মুকড়ির সঙ্গে সেই নাড়ু পলক ফেলতে উধাও হত। ফের আসত একপ্রস্ত নাড়ু।
এমনি করে নাড়ুর লোভে এ পাড়া ও পাড়া দাপিয়ে বেড়াতেন নিমাই দেবনাথ, জয়নাল আবেদিন, জিতেন্দ্র মণ্ডল, সাধন দেবনাথ, মহব্বত শেখেরা। দল বেঁধে আত্মীয় পরিজনের বাড়ি ‘মাসিমা’, ‘জ্যেঠিমা’ বলে হাজির হতেন। তারপরই টুক করে বিজয়ার প্রণাম সেরে শুরু হত ‘নাড়ু ভক্ষণ’।
লালগোলার অজয় ঘোষের স্মৃতিচারণা, ‘‘ছোটবেলায় দলবেঁধে বিজয়ার পর ক’দিন এ বাড়ি সে বাড়ি ঘুরে ঘুরে প্রণাম করতে যেতাম। প্রণামের থেকে মুড়ি, মুড়কি নাড়ুর দিকেই টানটাই ছিল বেশি। নাডুর সেই মিষ্টি গন্ধটা এখনও পাই।’’ তাঁদের বাড়িতেও রসুইখানায় বিজয়ার মিষ্টিমুখের জন্য নাড়ু, মুড়কি তৈরি হত। এখন অনেক বাড়ির মতো তাঁদের বাড়িতেও নাড়ুর পাঠ উঠে গিয়েছে।
এখন দিন পাল্টেছে। ঘর-বাইর দু’টোই সামলাতে হয় মেয়েদের। সংসারের হাজারটি খুঁটিনাটি থেকে চাকরির দায়দায়িত্ব পর্যন্ত সবই সামলাতে হয় তাঁদের। টান পড়েছে নাড়ু পাকানোর সময়ে। তাই দোকানের মিষ্টিতেই ভরসা রাখছেন আজকের গৃহস্থেরা। সে বিজয়ার নাড়ু হোক বা লক্ষ্মীপুজোর।
আজমিগঞ্জের নমিতা দাস বলেন, ‘‘খাঁটি গুড়ের খাঁটি ভিয়েনের তাক কি আর ব্যবসায়ীকে দিয়ে হয়।’’ কথায় কথায় জানান, লক্ষ্মীপুজোর দিন বিকেলে বারান্দায় মাদুর পেতে গোল হয়ে বসে নারকেল নাড়ু বানাতে বসতেন মা-দিদি-বৌদিরা। নারকেল কোরা শেষ হলে বড় কড়াইয়ে চিনি, এলাচ, তেজপাতা, নারকেল কোরা চাপিয়ে শুরু হত পাক দেওয়ার কাজ। পাক যাতে ধরে না যায় সে দিকে থাকত কড়া নজর। পাক দেওয়ার কাজ শেষ হলে কড়াই উনুন থেকে নামিয়ে শুরু হত নাড়ু তৈরি।
কিন্তু এখন সে বারান্দার যেমন অভাব, তেমন সুখ-দুঃখ বাঁটোয়ারা করে নেওয়ার পথও অনেক। প্রবীণারা বলেন, সেই হাতও আর নেই। পাক ঠিকঠাক না হলে যে নাড়ু মুঠোই হবে না! তাই ঝামেলা এড়াতে রেডিমেড নাড়ুর দিকে ঝুঁকছে আমজনতা।
বহরমপুরের মিষ্টান্ন ব্যবয়াসায়ী সঞ্জয়কুমার সাহা জানান, রসগোল্লা, রাজভোগ, চমচম যেমন বরাবর হয়, পুজোর সময়ও সেই রকমই হয়। তার বাইরে হয় পুজো স্পেশাল। এ বার পুজো স্পেশাল হিসাবে রয়েছে ২০ টাকা পিস ছানাবড়া, বালুসাই, জিভে গজা, আঙুল গজা, মাজা ফ্লেবার রসগোল্লা, শুকনো বোঁদে, মিহিদানা, ছানার পোলাও, কুচো নিমকি।
কান্দিতে এ বার চাহিদা মিহিদানা ও ছানার পোলাও-এর। ইসলামপুরের হাল্কা রসের স্পন্জ রসগোল্লাও বিজয়া, লক্ষ্মীপুজোয় নজর কেড়েছে। পুজোর বাজারে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় সব এলাকাতেই মিষ্টান্নের দাম এ বারও বেড়ে গিয়েছে। ব্যবসায়ীদের অবশ্য সাফাই, ছানা, মোয়া, তেল, ঘি-সহ যাবতীয় উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়ায় মিষ্টান্নের দামও বাধ্য হয়ে বাড়াতে হয়েছে।
তবে সবাই যে দোকানের নাড়ুর উপর ভরসা রাখছেন তা নয়। বহরমপুরের নীলিমা সাহা বলেন, ‘‘সব স্বীকার করি—সেই দিনকাল আর নেই, সময়েরও সত্যিই বড় অভাব। কিন্তু বছরের একটি দিন সংসারের সুখের জন্য ঘরের লক্ষ্মীরা না হয় পুজোয় একটু হাত লাগালেন! তাই আমাদের বাড়িতেই নাড়ু হবে।’’ ওই যে নাড়ু পাক ধরার সময় একটা মিষ্টি গন্ধ ঘরে ছেয়ে যায়, সংসারে সেটাই তো সুখ বয়ে আনে। আর বয়ে আনে স্মৃতি। তার ভার বড় কম নয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy