Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
Murshidabad

গঙ্গার ভাঙনে বিধ্বস্ত মহেশটোলা, প্রতাপগঞ্জ

জেলার বিশিষ্ট নদী বিশেষজ্ঞ সুর্য্যেন্দু দের মতে, গঙ্গাপাড়ের মাটির উপরের দু’ফুট পুরু মৃত্তিকা স্তর শক্ত মাটি দিয়ে তৈরি হলেও তার পরেই রয়েছে নরম সাদা বালির স্তর।

ভাঙন: গঙ্গার গ্রাসে শমসেরগঞ্জে বাড়ি। নিজস্ব চিত্র।

ভাঙন: গঙ্গার গ্রাসে শমসেরগঞ্জে বাড়ি। নিজস্ব চিত্র।

বিমান হাজরা
জঙ্গিপুর শেষ আপডেট: ২০ অক্টোবর ২০২২ ০৮:৫৭
Share: Save:

গঙ্গায় জল বাড়লেও বিপদ, জল কমলেও বিপদ। আর তার ফলেই বারবার ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে শমসেরগঞ্জের গঙ্গার ভাঙন। গঙ্গাগর্ভে বিলীন হয়ে যেতে বসেছে মহেশটোলা গ্রামের পূর্বপাড় এবং ক্ষতিগ্রস্ত প্রতাপগঞ্জও।

জেলার বিশিষ্ট নদী বিশেষজ্ঞ সুর্য্যেন্দু দের মতে, গঙ্গাপাড়ের মাটির উপরের দু’ফুট পুরু মৃত্তিকা স্তর শক্ত মাটি দিয়ে তৈরি হলেও তার পরেই রয়েছে নরম সাদা বালির স্তর। জল বাড়লে গঙ্গার জলের স্রোত যখন বালি মাটিতে ধাক্কা দেয়, তখন তা জলে ধুয়ে আলগা হয়ে যায়। ফলে উপরের শক্ত মাটি বা মাটির উপরের নির্মাণ হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে। জলে ধসে পরে তা।আবার উল্টো দিকে যখন বালি মাটির স্তর থেকে জলস্তর কমে নীচে নামে তখন দুর্বল ভিজে বালি মাটি উপরের শক্ত মাটির চাপ সইতে পারে না। ফলে তা জলের মধ্যে বসে পড়ে। তাই যে করেই হোক নদীপাড়ের বালি মাটির উপর জলের স্রোতের ধাক্কা আটকাতে হবে, সেটাই ভাঙন রোধের পথ।

সেচ দফতরের সুপারিন্টেন্ডিং ইঞ্জিনিয়ার সঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায় দীর্ঘ দিন মুর্শিদাবাদের ভাঙন কবলিত এলাকায় কাজ করছেন। তিনি বলছেন, ‘‘পাড়ের উপর জলের এই ধাক্কা আটকাতে আগে দরকার নদীর পাড় বরাবর বাঁশের ও জালের খাঁচার মধ্যে টাইট করে বালি বোঝাই বস্তা ফেলে পাড় বরাবর ফেলা। পাড়ের বালি মাটিকে জলের ধাক্কার হাত থেকে বাঁচাতে এ ছাড়া পথ নেই। দু’বছর ধরে একাজ চলবে। পরে তার উপর পাথর ও অন্য প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে।’’

গঙ্গায় জল এ বার অক্টোবর ও সেপ্টেম্বরে দফায় দফায় বেড়ে ভাঙনের কাজ শুরুতে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।মহেশটোলায় বাড়ি শ্যামল সরকারের। গঙ্গা এখন তাঁর বাড়ির প্রায় উঠোনে। তাঁরা সকলেই বাড়ি ছেড়ে উঠে গিয়েছেন অন্যত্র।তাঁর মা সবিতা সরকারের বয়স ৮৫ বছর। বাড়ি ছেড়ে তিনি আশ্রয় নিয়েছেন কিছু দূরের একটি শিশু শিক্ষা কেন্দ্রে। বলছেন, ‘‘গ্রামে যখন বৌ হয়ে আসি তখন গঙ্গা ছিল বহু দূরে। স্নান সেরে যেতে আসতেই ৪০ মিনিট। ভিজে কাপড় গায়েই শুকিয়ে যেত। আর এখন বাড়ির সামনে রাস্তা। তার পাশেই গঙ্গা। ভয়ে বাড়ি ছেড়ে জানলা, কপাট খুলে পালিয়ে আসতে হয়েছে। এই বয়সে কি এত ধকল সয়?’’

শমসেরগঞ্জের মহেশটোলা গ্রামটি পড়ে বোগদাদ নগর গ্রাম পঞ্চায়েতে। পঞ্চায়েত প্রধান ভৃগুরাম সরকারের বাড়ি মহেশটোলা গ্রামেই। ভাঙন আতঙ্কে তিনিও। নিজের বাড়ি থেকে বৃদ্ধা মাকে তাই সরিয়ে নিয়েছেন স্কুলের আশ্রয় শিবিরে। মালপত্রও সরিয়ে নিয়েছেন এক পরিচিতের বাড়িতে। কিন্তু নিজে স্ত্রী, ছেলেকে নিয়ে রয়েছেন এখনও বাড়িতেই। বুধবার বিকেলে ভৃগুরামবাবু বলেন, ‘‘ভাঙনে বিধ্বস্ত গোটা গ্রাম। এই অবস্থায় জানি হয়তো আমার বাড়িও তলিয়ে যাবে। তবু গ্রামবাসীদের ভরসা দিতেই এখনও আতঙ্ক নিয়েও বাড়িতে পড়ে রয়েছি। আমি বাড়ি ছেড়ে চলে গেলে ওরা বড় অসহায় হয়ে পড়বে।’’

প্রধান জানান, মহেশটোলা গ্রাম দু’ভাগে বিভক্ত। একটি গঙ্গা লাগোয়া পূর্ব পাড়। ১২৬ পরিবারের বসতি। মাঝে রাস্তা। পশ্চিমপাড়ের মহেশটোলায় প্রায় সাড়ে ৪শো পরিবার। তিনি বলেন, ‘‘পূর্ব মহেশটোলার একটি পরিবারের বাড়িও আর অবশিষ্ট নেই। মাঝে রাস্তা থাকায় পশ্চিম পাড় থেকে জল এখন কোথাও ১০ মিটার দূরে, কোথাও ৩০ মিটার দূরে। কিন্তু কত দিন রাস্তা আমাদের বাঁচাবে ভরসা নেই।’’

গত সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে দু’দফায় গঙ্গায় জল বেড়েছে। ফরাক্কা ব্যারাজ থেকে আশার খবর হল, বৃহস্পতিবার থেকে জল কমবে গঙ্গায়।কিন্তু কেন, এ ভাবে গঙ্গায় জল বাড়ে বা কমে?

গঙ্গা এসেছে উত্তরপ্রদেশ, বিহার, ঝাড়খণ্ড পেরিয়ে ফরাক্কায়। কাজেই ওই তিন রাজ্যে যখন বাড়তি বৃষ্টিপাত হয় তখন বাড়তি জল নদী বেয়ে আসে ফরাক্কায়। জমা হয় ফরাক্কা ব্যারাজে। ফরাক্কাতেই দু’ভাগ হয়েছে গঙ্গা। মূল গঙ্গার স্বাভাবিক প্রবাহ পথে ফরাক্কা ব্যারাজে বানানো হয়েছে ১০৯টি লকগেট। একই ভাবে ফরাক্কা থেকে খনন করে বানানো হয়েছে প্রায় ৩৮ কিলোমিটার ফিডার ক্যানাল, যে ক্যানালে জল আটকাতে বানানো হয়েছে ১১টি লকগেট। ভিন রাজ্য থেকে বাড়তি জল যখন ফরাক্কা ব্যারাজে এসে জমা হয়, তখন সে জল একটি নির্দিষ্ট স্তরে গেলেই খুলে দেওয়া হয় মূল প্রবাহের ১০৯টি লকগেটের মধ্যে প্রয়োজন মতো গেট। খুলে দেওয়া সেই লক গেট দিয়েই জল যায় শমসেরগঞ্জ, নিমতিতা হয়ে লালগোলা, ভগবানগোলা, বাংলাদেশ, ফের ভারতে ঢুকে রানিনগর, জলঙ্গি হয়ে ফের বাংলাদেশে। জলের চাপ থেকে ফরাক্কা ব্যারাজকে বাঁচাতেই এই সব লকগেট কার্যত খুলে দিতে বাধ্য হয় ফরাক্কা ব্যারাজ। সেই বাড়তি জলেই কোথাও দেখা দেয় ভাঙন, কোথাও বন্যা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Murshidabad landslide
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE