পর্যটকের ভিড় হাজারদুয়ারিতে।
দুগ্গাপুজো শেষ। মিটেছে বিজয়ার পালাও। মায়ের পরে মেয়ে লক্ষ্মীও মর্ত্যে ঘুরে গিয়েছেন। কিন্তু ছুটি-ছুটি মেজাজটা তো থেকেই গিয়েছে।
তার উপর আবার শীত আসবে আসবে করছে। কমেছে রোদের তেজ। হাল্কা উত্তুরে হাওয়া আর নরম রোদে গা ভাসিয়ে বেড়িয়ে পড়লেই হল।
কিন্তু বললেই তো আর হল না, রেস্তও চাই। কিন্তু সে না হয় নেপাল-ভুটান-দার্জিলিং কিংবা দক্ষিণ ভারতটা ঘুরে আসা না-ই হল। কাছেপিঠেই কোথাও। পকেটে জোর কম, তো কী আছে? সারা বছর মাস-মাইনে থেকে অল্প অল্প করে বাঁচিয়ে স্রেফ বেড়িয়ে পড়া বাঙালির বহুকালের অভ্যাস। বছরভর বাড়ি-অফিসের খাটুনির পর দু-তিন দিনের জন্য একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচা।
আর তাই একাদশীর পর থেকেই থিকথিকে ভিড় স্টেশনে। মা দুগ্গা জলে পড়তেই বেড়িয়ে পড়েছেন ওঁরা। কোজাগরীর আরাধনার জন্য অবশ্য দেরি করেছেন কেউ কেউ। কিন্তু পুজোআচ্চা মিটতেই বাক্সপ্যাঁটরা বেঁধে সপরিবার বেড়িয়ে পড়া।
গন্তব্যের তালিকায় রয়েছে, মায়াপুর, নবদ্বীপ, কৃষ্ণনগর, পলাশী থেকে হাজারদুয়ারি, লালবাগ কিংবা দীঘা, মন্দারমনি, শঙ্করপুর অথবা তারাপীঠ, বক্রেশ্বর, নলহাটি বা জয়রামবাটি, কামারপুকুর। উৎসব শেষের ফাঁকা দিনগুলো ক্রমশই ভরাট হয়ে উঠেছে পর্যটকদের আনাগোনায়।
‘‘আসলে গত কয়েক বছরে মানুষের চিন্তাভাবনাটাই বদলে গিয়েছে।’’ বলছেন, ফেডারেশন অব বেঙ্গল হোটেলিয়ার্সের রাজ্য সম্পাদক প্রসেনজিৎ সরকার।
কী রকম? যেমন, এক সময় নবদ্বীপ-মায়াপুর মানে ছিল তীর্থ করতে যাওয়া। কিন্তু এখন লোকে নিছক ছুটি কাটাতে যাচ্ছেন। হাতে কিঞ্চিৎ সময়, সামান্য পুঁজি থাকলেই হল। কেউ আসছেন হাজারদুয়ারির নবাবী ইতিহাসের খোঁজে তো কেউ নবদ্বীপ-মায়াপুরে আসছেন বর্ষায় গঙ্গা-জলঙ্গির সঙ্গম দেখতে।
প্রসেনজিৎবাবুর কথায়, “এ বার বর্ষার নদীর টাটকা মাছ খাওয়ার জন্যেও হোটেল বুকিং হয়েছে। তাঁরা আসার আগে জেনে নিচ্ছেন, এ বার এ দিকে নদীর মাছ কেমন উঠছে।’’
তিনি বলেন, “একটা সময় ছিল, যখন মানুষ দার্জিলিং যেত গরমকালে। এখন লোকে বেশি করে শীতকালে পাহাড়ে যায়। বরফ দেখবে বলে। প্রচণ্ড বর্ষায় সমুদ্র দেখতে কেমন লাগে তাতে মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। ফলে ‘অফ সিজন’ কথাটাই পর্যটনের ক্ষেত্রে ক্রমশ বাতিল হয়ে যাচ্ছে।”
ভক্ত সমাগম মায়াপুরে।
বিকিকিনির ছবিটাও বদলাচ্ছে। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, একটা সময়ে পুজোর পরের দিনগুলো ছিল চুপচাপ হাত গুটিয়ে বসে থাকার। কিন্তু এখন তেমনটা হয় না। উৎসব থাকুক আর নাই থাকুক, পর্যটকেরা থাকছেনই। নবদ্বীপ ব্যবসায়ি সমিতির সম্পাদক নিরঞ্জন দাস বলেন, “ছোটবেলার অনেক ধ্যনধারণাই এখন অর্থহীন। আসলে মানুষ এখন হাতে একটু সময় পেলেই বেড়িয়ে পড়ছেন। তার সুফল কিছুটা হলেও পাচ্ছেন সেই সব এলাকার ব্যবসায়ীরা। একদা যাকে ‘অফ সিজন’ বলা হত, সেই সব সময়েও এখন পর্যটকের ভিড় নবদ্বীপ-মায়াপুরে।”
বাড়ির সকলকে নিয়ে এক রাত মায়াপুরে কাটিয়ে পরের দিন নবদ্বীপ কিংবা বেথুয়াডহরি হয়ে সোজা মুর্শিদাবাদ। পরের দিন সেখানে হাজারদুয়ারি, লালবাগ ঘুরে নিজ নিকেতনে ফিরে যাওয়া।
মুর্শিদাবাদ জেলায় মূলত লালবাগকে ঘিরে পর্যটন শিল্প গড়ে উঠেছে। লালবাগের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে নবাবী আমলের বিভিন্ন পুরাকীর্তি। নবাবী আমলের সেই ইতিহাসকে চাক্ষুষ করতেই প্রতি বছর নভেম্বর থেকে মার্চের মাঝামাঝি পর্যন্ত চলে পর্যটকদের আনাগোণা। সংখ্যাটা নেহাত কম নয়। ১৪-১৫ লক্ষ দেশি-বিদেশি মুখের দেখা মেলে এ তল্লাটে।
পর্যটন মরশুম শুরু হওয়ার আগে এখন থেকেই বহরমপুর ও লালবাগের বিভিন্ন হোটেল সেজে উঠেছে। সাজিয়ে তোলা হয়েছে হোটেলের অন্দর। জেলা চেম্বার অফ কমার্সের যুগ্মা সম্পাদক স্বপন ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘পর্যটন মরশুমের দিকে তাকিয়ে থাকেন হোটেল-রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ী থেকে পরিবহণ শিল্পের সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীরা। এই সময়ে টাঙ্গাওয়ালা থেকে বেসরকারি বিভিন্ন গাইড আর্থিক দিক থেকে লাভবান হন।’’ স্বপনবাবু জানান, মুর্শিদাবাদের সিল্ক, খাগড়ার কাঁসার বাসন, শোলার তৈরি সামগ্রী কেনার প্রতিও পর্যটকদের বিশেষ চাহিদা থাকে। ফলে পর্যটনের মরশুমে ওই সমস্ত ব্যবসায়ীদের বেচাকেনাও বেড়ে যায়।
দুর্গাপুজোয় দশমীতে তিন দিনের জন্য সপরিবারের বেড়াতে আসেন দক্ষিণ কলকাতার বাসিন্দা গার্গী চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘‘হাজারদুয়ারি ও মিউজিয়ামের টানে মুর্শিদাবাদে বেড়াতে আসা। তবে মতিঝিল দেখে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছি।’’
তবে বেড়াতে এলে আগেভাগে হোটেল বুকিং করে আসাই বুদ্ধিমানের কাজ। কারণ, না হলে এ মরশুমে ঠাঁই মেলাই দায়। জানিয়ে দিচ্ছেন হোটেল মালিকেরাই। তার পর চেটেপুটে ছুটি উপভোগ। আর তারই ফাঁকে ইতিহাসকে ছুঁয়ে দেখা।
—ফাইল চিত্র।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy