Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

চেপটির জন্য সাদা ব্যাগ, ভলুরটা হলুদ

মেডিক্যাল কলেজের ডিউটি সেরে, তিনি আসবেন। তার পর, সব্বাইকে আলাদা করে পাত পেড়ে দেবেন। কলেজের ক্লাস সেরে তাঁর ভাত মাখা হাতের ঘ্রাণ না পেলে দুপুরটা ওদের বড় হুহু করে যে!

কুকুরদের খাওয়াচ্ছেন ঝর্ণা হাজরা। ছবি: গৌতম প্রামাণিক

কুকুরদের খাওয়াচ্ছেন ঝর্ণা হাজরা। ছবি: গৌতম প্রামাণিক

শুভাশিস সৈয়দ
বহরমপুর শেষ আপডেট: ১৬ জানুয়ারি ২০১৯ ০০:০৫
Share: Save:

বাড়ির সামনে চেপটি। একটু দূরে টান টান পা ছড়িয়ে ভলু। লালু রয়েছে আপন খেয়ালে, রাস্তার দিকে তাকিয়ে। টিটো অবশ্য ঘরের ভেতরে। ডিম্পিও রয়েছে খাটের উপরে শুয়ে। মিনি বাড়ির সিঁড়িতে বসে— চিনতে পারলেন?

নিশ্চয় নয়। ওরা সবাই বড়দির ছেলে-মেয়ে। ভাই-বোনও বলতে পারেন। সাবেক পরিচয় স্ট্রিট ডগ, পথ-কুকুর।

মেডিক্যাল কলেজের ডিউটি সেরে, তিনি আসবেন। তার পর, সব্বাইকে আলাদা করে পাত পেড়ে দেবেন। কলেজের ক্লাস সেরে তাঁর ভাত মাখা হাতের ঘ্রাণ না পেলে দুপুরটা ওদের বড় হুহু করে যে!

আসুন এ বার বড়দি’র সঙ্গে আলাপটা সেরে নিই— বহরমপুরের শহিদ সূর্য সেন রোডে একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের পাঁচিল ঘেঁষা কয়েকটি ঘর নিয়ে গড়ে উঠেছে হাজরাপাড়া। বড়দি, চন্দনা হাজরা থাকেন সেখানেই। যাঁর দিন যাপনটা পারতপক্ষে ওদের আঁকড়েই। বস্তুত ওদের জন্যই।

মেয়ে এসে ‘ওদের’ খাবার মেখে দেবে। তার পরে, সেই খাবারের থলে হাতে শহরের আনাচ কানাচ ঘুরবেন যিনি, মেয়ের এই সারমেয়-সখ্যতায় তাঁরও কিঞ্চিৎ অবদান রয়েছে বইকি, তিনি ঝর্ণা হাজরা, বড়দির মা।

পথ কুকুরদের নিয়ে মা-মেয়ের এই দিনযাপন বহরমপুরের অলি-গলিতে এখন নতুন করে প্রাণ পেয়ে গিয়েছে যেন। পুরসভার সাফাইকর্মী ঝর্ণা বলছেন, ‘‘এ নিয়ে কম টিপ্পনী শুনতে হয়নি। খাবার দিলে তারা নাকি বাড়ির সামনে জাঁকিয়ে বসবে। চলাচলই দুরূহ হয়ে উঠবে। আপত্তির আরও কত কারণ।’’ তবে, দমে যাননি ঝর্ণা। মেয়ের ইচ্ছের সঙ্গে নিজের সাধ বুনে দু’জনেই এখন শহরের সারমেয়প্রেমী মা-মেয়ে।

হিসেব দিচ্ছেন চন্দনা, ‘‘রোজ কিলো চারেক ভাত। তার সঙ্গে মুরগির মাংসের ছাঁট রান্না হয় বাড়ির গ্যাসের উনুনেই। ২ টাকা কিলো রেশনের চাল পড়শিদের কাছ থেকে বাড়তি দাম দিয়ে কিলো প্রতি ২০ টাকা দর দিয়ে কিনে নিই। তার পরে সকাল থেকে মায়ের রান্না। মনে হয় বাড়ির সক্কলের জন্যই বুঝি মা
রাঁধতে বসল।’’

এ প্রেমের একটা নেপথ্য গল্প রয়েছে। ঝর্ণার পাঁচ মেয়ের মধ্যে বড় চন্দনা। বরাবরই কুকুর-বেড়াল, পায়রা-মুরগি নিয়ে তার সংসার। মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সাফাইকর্মী চন্দনা তাঁর বেতনের অর্ধেকের বেশি টাকা খরচ করে দিতেন রাস্তার কুকুরদের। তা এক দিন, মা-মেয়ের তা নিয়ে কথা কাটাকাটির জেরে নিজের জীবনটাই শেষ করে দিতে চলেছিলেন চন্দনা। বলছেন, ‘‘রাস্তার ওই ছড়িয়ে থাকা সংসারটাই বোধহয় আমাদের মধ্যে সব দূরত্ব মুছে দিয়েছে।’’

পুরসভার কাজ সেরে ফিরেই রান্না নিয়ে বসেন ঝর্ণা। প্রাণী চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে নুন ছাড়া রান্না, সামান্য হলুদ দিয়ে সেদ্ধ করা মাংস ভাতের সঙ্গে মাখিয়ে প্রত্যেকের জন্য আলাদা ব্যাগে ভরে ঝর্ণা বেরিয়ে পড়েন রাস্তায়।

তিনি বলছেন, ‘‘ও সব হিসেব আছে, চেপটির জন্য সাদা ক্যারিব্যাগ, ভলুকে হলুদ আর পুরসভার বাইরে যারা শুয়ে থাকে তাদের জন্য কালো ক্যারিব্যাগের খাবার।’’

শুধু হাতে তৈরি ভাত-মাংস নয়, আহত-অসুস্থ পথ-কুকুরদের নিয়েও মা-মেয়ের নিত্য দৌড়ঝাঁপ দেখেন পড়শিরা। চন্দনা বলছেন, ‘‘ও ভাবে বলছেন কেন, ওরা তো আমাদের পরিবারেরই কেউ, তাই না!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Street D Berhampur
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE