নবদ্বীপের গানমেলার উৎসবে যোগ দিতে এসেছেন ভাগ্যকুলের জমিদারমশাই। কথায় আছে মাঘের শীতে বাঘ কাঁপে। গঙ্গার কনকনে ঠান্ডা হাওয়ায় হাড় পর্যন্ত কেঁপে উঠছে। মাথায় পাগড়ি, পায়ে মোজা, গায়ে বহুমূল্য জামেয়ার শালেও সে শীত বাগ মানছে না। মন্দিরে গিয়ে মহাপ্রভুকে প্রণাম করার সময় তাঁর মনে হল, এই প্রবল শীতে দেবতাও নিশ্চয় কষ্ট পাচ্ছেন। সেই মাঘেই বিষ্ণুপ্রিয়া সেবিত মহাপ্রভু বিগ্রহের অঙ্গে উঠেছিল কাশ্মীরি জামেয়ার শাল। মন্দিরের প্রবীণ সেবায়েত লক্ষীনারায়ণ গোস্বামী জানান, জমিদারের উপহার দেওয়া পশমের শালের উপর কালো সুতোয় সূক্ষ নকশার সেই জামেয়ার দুষ্প্রাপ্য।
এ ভাবেই গোটা শীতকাল জুড়ে নবদ্বীপের বিভিন্ন মঠমন্দিরে বিগ্রহের শ্রীঅঙ্গে শোভা পায় শীত পোশাক। জামেয়ার শাল থেকে তুলোর তৈরি কোট, কাশ্মীরি শালের থান কেটে তৈরি পাঞ্জাবি, চুড়িদার, ঘাগরার পাশাপাশি পাঞ্জাবী থেকে ব্র্যান্ডেড কোম্পানির সোয়েটার, টুপি, দস্তানা, মাফলারে সাজানো হয় দেবতাকে।
নবদ্বীপের অধিকাংশ মঠমন্দিরের প্রচলিত আছে ‘আত্মবৎ সেবা’। যার অর্থ, খাদ্য-পরিধেয় ইত্যাদি বিষয়ে ভক্ত দৈনন্দিন জীবন যে ভাবে যাপন করেন, সে ভাবেই নবদ্বীপের মঠ-মন্দিরে বছরভর পুজার্চনা হয়। তাই ঋতুর সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায় দেবতার পোশাক ও ভোগের পদ। নবদ্বীপের মহাপ্রভু মন্দিরের গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর পরিধেয় বদলে যায় কার্তিক মাসের প্রথম দিন থেকে। সুতি বা হালকা পোশাকের বদলে তসর কিম্বা ‘কেঠে মটকার’ পাঞ্জাবি। সঙ্গে ‘এন্ডির’ চাদর। এই পোশাকও বদলে যায় অঘ্রান মাস পড়তেই। তখন গৌরাঙ্গদেবের গায়ে ওঠে কাশ্মীরি শাল। মাঘের শীতে গায়ে দেওয়া হয় তুলোর ফুলহাতা বালাপোষের কোট। সঙ্গে উলের তৈরি চুমকি-জরির কানঢাকা টুপি, মাফলার।
শীতপোশাকে ফের বদল ঘটে দোল পূর্ণিমায়, মহাপ্রভুর জন্মতিথির দিনে। অন্নপ্রাশন উৎসবে লালচেলি পরিয়ে সে দিন তাঁকে সাজানো হয় সদ্যোজাত শিশুর মতো। দোলের পর থেকে ফের তাঁর গায়ে উঠতে শুরু করে মসলিন বা আদ্দির পাঞ্জাবি-ধুতি। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠের গরমে বিগ্রহে গায়ে ওঠে সুতির উত্তরীয়।
নবদ্বীপের বেশিরভাগ মন্দিরে ঋতুভেদে দেববিগ্রহের পোশাক অনেকটা একই রকম। তবে উৎসবের সময় ভিন্ন ভিন্ন বেশে সেজে ওঠেন দেবতা। বিষ্ণুপ্রিয়াদেবী সেবিত মহাপ্রভু মন্দিরের বিগ্রহের পরে নবদ্বীপের দ্বিতীয় প্রাচীন গৌরাঙ্গ বিগ্রহ মণিপুর রাজবাড়ির ‘অনু মহাপ্রভু’। শীত বলে নয়, সারা বছরই মণিপুর রাজপরিবার সেবিত এই বিগ্রহ রকমারি পোশাকে সুসজ্জিত থাকে। তবে শীতে ওয়েস্টকোট থেকে উলের পোশাক সবই পরানো হয়। নবদ্বীপের হরিসভা মন্দিরের ‘নাটুয়া গৌরকে’ বিজয়া দশমীর পর থেকে ফুলহাতা পোশাক পরানো শুরু হয়। বলদেব মন্দিরের বলদেব জিউর মাথায় মুকুট থাকে বলে অবশ্য টুপি পরানো সম্ভব হয়না। জন্মস্থান মন্দিরের গৌরনিতাইয়ের ঘরে শীতের রাতে ব্যবহার করা হয় রুম হিটার। কান্দির রাজা লালাবাবু বৃন্দাবন থেকে ফিরে রাজবাড়িতে প্রতিষ্ঠা করেন রাধাবল্লভ জিউর মন্দির। সেই মন্দিরে রাজকীয় ভাবে দেবতার সেবাপুজো হয় বারো মাস। শীতকালে দিনে দু’বার পোশাক বদল হয় রাধা এবং শ্রীকৃষ্ণের। সোয়েটার, মাফলার, টুপি, চাদর সবই বদলে যায় সকাল-বিকেল। সেবায়েত প্রশান্ত অধিকারি জানান, শীতে বিগ্রহকে স্নান করাতে গরমজলও ব্যবহার করা হয়। শয়নের সময় বিগ্রহের গায়ে দেওয়া হয় লেপ।