Advertisement
২১ মে ২০২৪

অটুট দম, দৌড়ে পুরস্কৃত নরেন

জেদের কাছে হার মানল বয়স। অদম্য ইচ্ছে আর জেদের কাছে বয়স যে কোনও ‘ফ্যাক্টর’ নয় তা আবারও প্রমাণ করলেন বছর প়ঞ্চান্নর নরেন ফুলমালি। দেশের ৬৯তম স্বাধীনতা দিবসে ৯ কিলোমিটারের এক দৌড় প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিল সাগারদিঘির বাসস্ট্যান্ড লাগোয়া বিজয় সরস্বতী ক্লাব। ৭২ জন প্রতিযোগী যোগ দিয়েছিল তাতে।

দৌড়চ্ছেন নরেন ফুলমালি। — নিজস্ব চিত্র।

দৌড়চ্ছেন নরেন ফুলমালি। — নিজস্ব চিত্র।

বিমান হাজরা
সাগরদিঘি শেষ আপডেট: ১৭ অগস্ট ২০১৫ ০০:৩৪
Share: Save:

জেদের কাছে হার মানল বয়স।

অদম্য ইচ্ছে আর জেদের কাছে বয়স যে কোনও ‘ফ্যাক্টর’ নয় তা আবারও প্রমাণ করলেন বছর প়ঞ্চান্নর নরেন ফুলমালি।

দেশের ৬৯তম স্বাধীনতা দিবসে ৯ কিলোমিটারের এক দৌড় প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিল সাগারদিঘির বাসস্ট্যান্ড লাগোয়া বিজয় সরস্বতী ক্লাব। ৭২ জন প্রতিযোগী যোগ দিয়েছিল তাতে। সব প্রতিযোগীরই বয়স ১৬ থেকে ২৪-এর মধ্যে। ব্যতিক্রমী ছিলেন শুধু নরেনবাবু। বয়স যে তাঁর পঞ্চান্ন ছুঁয়েছে। তাই তিনি যখন দৌড়নোর জন্য হাফ প্যান্ট পরে ‘স্টার্টিং লাইন’-এর কাছে এসে দাঁড়ালেন তখনও বিস্ময়ে চোখ গোল হয়ে গিয়েছিল দর্শকদের। টিটিকিরিও করেছিলেন কেউ কেউ। কারও আবার ভয় হচ্ছিল মানুষটা দৌড় শেষ করতে পারবেন তো। কিন্তু নিজের জেদে অটল ছিলেন নরেনবাবু। তাই মাঝপথে গলা শুকিয়ে গেলেও, শরীর এলিয়ে এলেও ট্রাক ছেড়ে পালাননি। মোরগ্রাম সেতু থেকে শুরু করে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক পেরিয়ে রতনপুর হয়ে ৪০ মিনিটের মধ্যে সাগরদিঘিতে ফিনিশিং লাইন ছুঁলেন তিনি। মুখে তখন তাঁর ভুবনজয়ী হাসি। আর তাঁকে অভিনন্দন জানাতে হাততালিতে ফেটে পড়েছে চারদিক।

তবে তিনি কোনও স্থান দখল করতে পারেননি। তবু তাঁর এই অদম্য জেদকে কুর্নিশ জানাতে তড়িঘড়ি পুরস্কারের কথা ঘোষণা করেন ক্লাব কর্তৃপক্ষ। একটি ছাতা, ব্যাগ আর গেঞ্জি তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হয়। সঙ্গে শংসাপত্র। পুরস্কার পেয়ে ‘আনপড়’ নরেনবাবু ছুটে গিয়েছিলেন তাঁর ১০ ফুট বাই ৫ ফুটের জরাজীর্ণ ঘরে। ষষ্ঠ শ্রেণির পড়ুয়া মেয়ের হাতে তুলে দেন শংসাপত্রটি। বাবার সাফল্যের স্বীকৃতিকে নিজের বইয়ের মধ্যে সযত্নে রেখেছে মেয়ে সারথী।

নরেনবাবু পেশায় রিকশাচালক। বাড়িতে দিন আনি দিন খাই অবস্থা। তবু দৌড় প্রতিযোগিতার কথা শুনে মনটা চনমন করে উঠেছিল। তাই সাত-পাঁচ না ভেবে কড়কড়ে পঞ্চাশ টাকা দিয়ে নিজের নামটা লিখিয়ে ছিলেন। তবে লোকে যাতে ‘বাঁকা কথা’ না বলে তাই কাউকে জানতে দেননি। তবে নিজের স্ত্রীর কাছে লুকোননি। ভেবেছিলেন স্ত্রীর সমর্থন পাবেন। কিন্তু কোথায় কী। উল্টে স্ত্রীর থেকেই এল তীব্র আপত্তি। এই বয়সে ৯ কিলোমিটার দৌড়! এত পথ দৌড়তে গিয়ে স্বামীক যদি কিছু হয়ে যায় তা হলে সংসারের কী হবে। মেয়ের পড়াশোনার কী হবে। তাই পইপই করে বারণ করে দিয়েছিলেন।

কিন্তু স্ত্রীর বারণ মনঃপুত হয়নি। তাই স্ত্রী যাতে জানতে না পারে প্রতিযোগিতার দিন বাড়ির সকলে ঘুম থেকে ওঠার আগেই বেরিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। তারপর সন্ধেবেলা যখন পুরস্কার আর শংসাপত্র নিয়ে বাড়ি ফিরলেন তখন স্ত্রীর মুখে হাসি ফুটেছে। স্ত্রী আমতিদেবী বলেন, ‘‘সংসার টানতে নিজে লোকের বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করি। তাই অমন অলক্ষুণে কথা শুনে না বলেছিলাম।’’ তাঁর কথা, ‘‘প্রতিদিন উনি বাড়ি থেকে চা-মুড়ি খেয়ে রিকশা নিয়ে বেরোন। পাছে আমি বাধা দিই তাই ঘুম থেকে ওঠার আগে উনি কখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে বুঝতে পারিনি।’’ তার পর একগাল হাসে বলেন, ‘‘খুব ভাল লাগছে। কত লোকে স্বামীর প্রশংসা করছেন। ধন্যি ধন্যি করছেন। পুরস্কারের ছাতাটাও কাজে লাগবে। দুপুর রোদে ভ্যান চালিয়ে মানুষটা হাঁফিয়ে ওঠেন। এখন রোদ, বৃষ্টি থেকে কিছুটা তো বাঁচবেন।’’

নরেনবাবুর দাদা ধীরেনবাবু সাগরদিঘি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ঠিকাশ্রমিক। সন্ধ্যে বেলায় বাড়ি ফিরে ভায়ের কীর্তিকলাপ শুনে হতবাক তিনিও। রবিবার বাড়ির দাওয়ায় বসে তিনি বলেন, ‘‘বাড়ি ফেরার পথে শুনছিলাম ভাইয়ের দৌড়নোর কথা। বাড়ি ফিরতে পুরস্কারের লাল হলুদ রঙের গেঞ্জিটা হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল দাদা, তোকে তো কখনও কিছু দিতে পারি না। তুই গেঞ্জিটা পর। তোকে মানাবে ভাল।’’ শুনে বুকটা ভরে গিয়েছিল বলে জানালেন তিনি।

নরেনবাবু সঙ্গেই রিকশা টানেন উত্তম ফুলমালি, দীনেশ দাস, খোকন দাসেরা। রবিবার সাগরদিঘির রিকশা স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে তাঁরাই বলছেন, ‘‘এই বয়সে নরেনদা প্রমাণ করেছেন ইচ্ছে ও জেদ থাকলে সবই সম্ভব।’’

ছেলের সাফল্যে খুশি অশীতিপর সুশীলাদেবীও। তিনি বলেন, ‘‘সকালে বাড়িতে শুনেছিলাম ছেলে নাকি দৌড়তে গিয়েছে। তাই নাতির হাত ধরে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম বড় রাস্তার ধারে। দেখি ছেলে হাফ প্যান্ট পরে দৌড়চ্ছে। রাস্তার দু’ধারে কয়েক শো লোক হাততালি দিয়ে ছেলেকে উৎসাহ দিচ্ছেন। এখন ভাবছি ঠিক মতো খাবার জোটে না দু’বেলা। অতটা পথ কী ভাবে দৌড়ল ও।’’

আর কী নিজের সম্বন্ধে কী বলছেন নরেনবাবু?

তিনি বলেন, ‘‘ছোটবেলায় ফুটবল খেলতাম। তাই দৌড়ঝাঁপের দিকে একটু দুর্বলতা রয়েছে। ক’দিন ধরে দৌড় প্রতিযোগিতার কথা প্রচার করছিল ক্লাবের লোকজনেরা। তাই নামটা লিখিয়ে দিয়েছিলাম।’’ তাঁর কথা, ‘‘দৌড়তে একটু কষ্ট হয়েছে ঠিকই। কিন্তু জেদ ছিল দৌড় শেষ করবই। রাস্তার দু’দিকে শয়ে শয়ে মানুষ হাততালি দিয়ে উৎসাহ দিচ্ছিলেন। তাতে জেদটা আরও বেড়ে যায়। তাই কখন যে গন্তব্যটা ছুঁয়ে ফেলেছি বুঝতেই পারিনি।’’

নরেনবাবুর কৃতিত্বে উচ্ছ্বসিত উদ্যোক্তা ক্লাবের কর্মকর্তারাও। ক্লাবের ক্রীড়া সম্পাদক সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, ‘‘নাম জমা দেওয়ার সময় আমরা ওকে বার বার ভেবে দেখতে বলেছিলাম। এই বয়সে এতটা দৌড়! কিন্তু তিনি কথা শোনেননি। কিন্তু তিনি যখন দৌড় শেষ করলেন তখন সত্যিই অবাক হয়ে গিয়েছি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Naren sagardighi raghunathganj biman hazr
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE