Advertisement
১৮ মে ২০২৪

শিল্পকলার পুনর্জাগরণই ছিল তাঁর প্রিয় স্বপ্ন

তাঁকে দেখে অবনীন্দ্রনাথের মনে হয়েছিল পাহাড়ের উপর যেন চাঁদের আলো পড়েছে, ভারতীয় চিত্রকলার সেই পুনর্জাগরণের সেই মুহূর্তে নিবেদিতার ভূমিকার খোঁজ দিলেন রাজনারায়ণ পালপরিব্রাজক অবস্থায় বিবেকানন্দ ভারতের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে পরিভ্রমণ করেছেন আর গভীর অভিনিবেশের সাথে চাক্ষুষ করেছেন অঞ্চল ভেদে স্থাপত্য-ভাস্কর্য-চিত্রকলার বর্ণময় রূপ। বহির্ভারতে  সিঙ্ঘলের নানা শহরের প্রত্নকীর্তি, চিনের ক্যাণ্টনের বা জাপানের বিভিন্ন স্থানের শিল্প-নিদর্শন প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হয়েছিল তাঁর।

শেষ আপডেট: ০৪ জানুয়ারি ২০১৯ ০৩:৪১
Share: Save:

ফ্রান্সের বার্বিজোন নামক গ্রামে বাস করতেন জ্যাঁ ফ্রাকোয়েস মিলে, যার শিল্প প্রতিভা বার্বিজোনকে গোটা ইউরোপে পুণ্য শিল্পভূমির মর্যাদা দিয়েছিলেন। এই মিলে ‘অঞ্জেলাস’ নামে একখানি ছবি এঁকেছিলেন। যার বিষয়বস্তু – এক কৃষক ও কৃষক-রমণী দূরাগত উপাসনা-ঘণ্টার ধ্বনি শুনে খেতে গোল আলু তুলতে গিয়েও ভক্তিভরে অবনত মস্তকে ভগবানকে স্মরণ করছে। ছবিটিতে যেন একটা জাতির শ্রম-ধর্মের দ্বারা পবিত্র হয়ে ওঠার ভাব বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে। নিবেদিতা ভারতের আধুনিক শিল্পীদের এই ভাবের ছবি আঁকতে উদ্ভুদ্ধ করেছিলেন। তাঁর উৎসাহে প্রবাসীতে ছবিটি প্রকাশিত হয়। সঙ্গের সংক্ষিপ্ত চিত্র-পরিচিতিতে নিবেদিতা লেখেন, “This picture has always seemed to me to have a special message for the Modern Indian Artists. For there is nothing here that did not come to Millet straight form Nature. Everything in the scene is a reproduction from fact. Yet it is fact reproduced, not as by the photograph but as by the poet, the prophet, the seer, it is nature and fact interpreted by the mind and the heart of a great man.

It is realism. True. But it is also idealism. Ah is there no scene, no figure in India to-day, that deserves the love that would struggle till it, too, had been expressed as worthily as this?” (প্রবাসী, ৬ষ্ঠ ভাগ, ৪৭২)

ভারতের জাতীয় শিল্পের পুনর্জাগরণই ছিল তাঁর প্রিয় স্বপ্ন। এ দেশ যখন তার প্রাচীন শিল্পকে ফিরে পাবে, নিবেদিতা বিশ্বাস করতেন, তখনই সে শক্তিশালী জাতিরূপে আত্মপ্রকাশ করবে। ১৯০৬ এর মাঝামাঝি সময়ে ওলি বুলকে লেখা এক চিঠিতে(১৬-৭-১৯০৬), ভারতীয় শিল্প কেমন হবে তার এক রূপ-রেখা তুলে ধরেছিলেন, যা’ ভারত-শিল্পের কাছে তাঁর প্রত্যাশার চিত্রটি মেলে ধরে। সেখানে দেখি চিত্রকলায় ভারতীয় রীতি বলতে নিবেদিতা বুঝতেন ঐতিহ্য মণ্ডিত প্রাচীন রীতি, পুরোনো পাণ্ডুলিপি ও ভাস্কর্য্য দ্বারা প্রভাবিত শিল্প সৃষ্টিকে। মস্তিস্ক ও হৃদয়ের মেলবন্ধনে অঙ্কিত চিত্রই তাঁর দৃষ্টিতে আদর্শ। কেবল চোখ আর হাত দিয়ে আঁকা ছবি, ছবি নয়। তা ভাবাত্মক হওয়া চাই। আর এই ধারার শিল্পের পুনর্জাগরণের জন্য, প্রসারের জন্য অনেক সুদূরের কথা নিজের মত করে ভেবেছিলেন। এ জন্য নির্দিষ্ট পরিকল্পনাও ছকে ছিলেন। তাঁর ইচ্ছা ছিল, এক হাজার পাউণ্ডের এক তহবিল গড়ে তা’ দিয়ে ভবিষ্যতে শিল্প কলায় প্রতিযোগিতার ব্যাবস্থা করা। আর সেই টাকায় যা’ সুদ হবে, তা’ দিয়ে প্রতি বছর প্রাচ্য ধরণের চিত্রের জন্য বিজয়ী শিল্পীকে পুরষ্কৃত করা। তবে সে পরিকল্পনা রূপ পাবার আগেই মৃত্যু এসে তাঁকে আলিঙ্গন করেছিল।

নিবেদিতা যেন শিল্পের দিদিমণি যিনি স্বামীজির শিল্প-জ্ঞানে সমৃদ্ধ হয়ে একটা গোটা জাতিকে শিল্পের পাঠ পড়িয়েছিলেন। পরিব্রাজক অবস্থায় বিবেকানন্দ ভারতের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে পরিভ্রমণ করেছেন আর গভীর অভিনিবেশের সাথে চাক্ষুষ করেছেন অঞ্চল ভেদে স্থাপত্য-ভাস্কর্য-চিত্রকলার বর্ণময় রূপ। বহির্ভারতে সিঙ্ঘলের নানা শহরের প্রত্নকীর্তি, চিনের ক্যাণ্টনের বা জাপানের বিভিন্ন স্থানের শিল্প-নিদর্শন প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হয়েছিল তাঁর। ইংল্যান্ড আমেরিকার শিল্প-সংগ্রহালয়ে তাঁর যাতায়াত ছিল। একাধিক বার গিয়েছেন প্যারিসের ল্যুভর মিউজিয়ামে। দেখেছেন জার্মানির নানা শহরের শিল্প-ঐশ্বর্য। ঘুরেছেন ভিয়েনার নানান সংগ্রহালয়। বাদ যায়নি রোম, ফ্লোরেন্স, পম্পেই। গ্রীস, কনস্টানটাইন, মিশর বা তুরস্কের শিল্প-নিদর্শনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা তাঁর জ্ঞান-চক্ষু খুলে দিয়েছিল। এর সাথে যুক্ত হয়েছিল অসীম পড়াশুনা আর সহজাত অন্তর্দৃষ্টি। এ সবের মেলবন্ধন স্বামীজিকে যথার্থ এক শিল্প-গুরুতে পরিণত করেছিল। আর নিবেদিতা পেয়েছিলেন সেই গুরুর শিল্প-দীক্ষা। স্বামীজি কি ভাবে ধরে ধরে ভারত-শিল্পের মর্ম্মকথা তাকে বুঝিয়েছিলেন, সে সব কথা ধরা আছে তার নোটস অন সাম ওয়াণ্ডারিংস উইথ দি স্বামী বিবেকানান্দ বা দি মাস্টার অ্যাজ আই স হিম গ্রন্থে। শুধু বিখ্যাত শিল্প নির্দশনগুলিই নয়, ভারতের মাঠ-ঘাট খেত-খামার গ্রাম-জীবনের অন্তর্নিহিত সৌন্দর্যের যে স্বরূপ স্বামীজি তাঁর ব্যাখ্যায় নিবেদিতার সামনে তুলে ধরেছিলেন, সে শিক্ষাই তাঁকে পরবর্তী কালে যথার্থ শিল্প-রসজ্ঞে পরিণত করেছিল। যার নিদর্শন দি ওয়েব অফ ইণ্ডিয়ান লাইফ , স্টাডিস ফ্রম এ্যান ইণ্ডিয়ান হোম, দি ফুটফল অফ ইণ্ডিয়ান হিস্ট্রি। স্বামী বিবেকানান্দ ছাড়াও ভারতীয় মনীষীদের সান্নিধ্য নিবেদিতার শিল্প-জ্ঞানকে ঋদ্ধ করেছিল। ভুললে চলবে না, শিল্পই সকলের মাঝে এক সাধারণ ভাষা সৃষ্টিতে সক্ষম। পরাধীন ভারতে মাতৃভূমির গঠনে তাই এর পুনর্জাগরণের একান্তই প্রয়োজন ছিল বলে নিবেদিতা মনে করতেন (Voice of India, 1967, Kolkata)। বাগবাজারে নিজের স্কুলের ছাত্রীদের তিনি লাইন করে বসিয়ে শিল্প-শিক্ষা দিতেন। সুতোর কাজ থেকে শুরু করে চিত্রাঙ্কন কিছুই বাদ যেত না। স্নেহের সঙ্গে নিজে হাতে ধরে তাদের সব শেখাতেন। আগেই দেখেছি নন্দলাল বসু অসিত হালদার সুরেন গাঙ্গুলী বা অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর কেউই সে শিক্ষার বৃত্তের বাইরে থাকতে পারেননি। এমনকি আনন্দ কুমারস্বামী বা ওকাকুরা পর্য্যন্ত। আসলে যে কোনো জাতির শক্তির উৎস তার নিজ ক্ষমতায় বিশ্বাস। অতীতের মহৎ কার্যের ওপর শ্রদ্ধাশীল হলে তবেই এ বিশ্বাস অন্তরে জাগ্রত হতে পারে। তাই বিদেশি শাসনে ভারতবাসী যখন ক্লিষ্ট, হীনম্মন্যতায় আচ্ছন্ন, তখন সে জাতির আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে নিবেদিতা কেবল ভারতের আধ্যাত্মিক কর্মযোগই নয়, শিল্প-কলা-বিজ্ঞান-বাণিজ্য—সর্বক্ষেত্রেই ভারতের গৌরবময় কর্মকাণ্ডের কীর্তন করেছেন। অন্যকেও অতীত গৌরবে গৌরবান্বিত হতে উৎসাহিত করতে এগিয়ে এসেছেন। অতীত ভারতের সব কিছুর অন্ধ স্তাবক তিনি নন। প্রাচীন যা কিছু ভালো, মহৎ, আধুনিক জীবনে কেবল তাকেই আবাহন জানাবার পক্ষপাতী ছিলেন। আমাদের বর্তমান পরানুকরণপ্রিয় সমাজে আর এক জন নিবেদিতার বিশেষ প্রয়োজন তৈরি হয়েছে, যিনি এসে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবেন আমরা ভারতীয়, ভারতবর্ষ আমাদের দেশ, যে দেশ গৌরবময় শিল্প-সংস্কৃতির এক উজ্জ্বল উত্তরাধিকার বহন করে চলেছে। (শেষ)

শিক্ষক, মহাদেবানন্দ মহাবিদ্যালয়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Sister Nivedita Sclupture
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE