বুঁদ নেট-দুনিয়ায়। ধুবুলিয়ার একটি ক্লাবে। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য।
যে রোগের যে দাওয়াই!
তাই বলে ওয়াই-ফাই?
‘‘পানশালাতে বাবুরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে পারেন। আর যত তাড়াতাড়ি আমার দোকানে পান খেতে এসে। এখন ওয়াই-ফাই চালু হওয়ায় আর কেউ রা কাড়ে না। ভাবখানা এমন যেন পান দিতে যত দেরি হয় ততই মঙ্গল!’’ ভাদ্রের সন্ধ্যায় মুচকি হাসছেন বহরমপুরের প্রতুলশঙ্কর পোদ্দার। লোকজন যাঁকে টাট্টু নামেই বেশি চেনেন।
ধুবুলিয়ার আনন্দনগরে আবার আর এক দৃশ্য। সকাল-বিকেল-দুপুর সময় পেলেই কিশোর-কিশোরীরা মোবাইল হাতে ছুটছেন স্থানীয় অশোক স্মৃতি সঙ্ঘে। সোমবার, স্বাধীনতা দিবসের সকাল থেকে আটপৌরে আস্ত ক্লাবটাই যে ওয়াই-ফাই জোন। সৌজন্যে ওই ক্লাবেরই সদস্যরা।
নিখরচায় এমন পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনা হাতছাড়া করতে চাইছেন না কেউই। অনলাইনে ফর্ম ফিল আপ থেকে শুরু করে ফেসবুকে সুপারলাইক, সবই চলছে ঝড়ের বেগে। থ্রি জি-ফোর জি উড়িয়ে তামাম তল্লাট এখন ওয়াইফাইয়ে বুঁদ। পাশের গ্রামেরও কেউ কেউ জানতে চাইছেন, ‘‘ইউটিউব থেকে রুস্তম ও মহেঞ্জো দারো-র গান ডাউনলোড করব। হ্যাঁ রে, তোদের ওখানে কি যাব একদিন?’’
বহরমপুরের টাট্টুর পানের দোকানে অবশ্য যে কেউই যেতে পারেন। কিন্তু পানের সঙ্গে পাসওয়ার্ড অবশ্য সবার জন্য ‘ফ্রি’ নয়। কেন? টাট্টু বলছেন, ‘‘তাহলে তো ঢাকের দায়ে মনসা বিক্রি হয়ে যাবে দাদা। অন্যরাও সব কাজকর্ম ফেলে এখানে এসে মোবাইল নিয়ে বসে থাকবে। এ ব্যবস্থা শুধু বাঁধা খরিদ্দারদের জন্য। সপ্তাহান্তে বদলে দিই পাসওয়ার্ডও।’’
তাই বলে পানের দোকানে ওয়াই-ফাই?
বহরমপুর অবশ্য জানে টাট্টুর পক্ষে এটা কোনও ব্যাপারই নয়। বছর বাইশ আগে পারিবারিক ব্যবসায় যোগ না দিয়ে পানের ব্যবসা শুরু করেন টাট্টু। পানমশলা কোম্পানির লোকজন এসে দোকানও সাজিয়ে-গুছিয়ে দেন। ইয়ার-দোস্তরা অবশ্য মজা করে বলতেন, ‘‘কী রে, শ্বশুরবাড়ি থেকে যৌতুক নিয়ে এ সব করছিস নাকি!’’ টাট্টু সে কথায় রাগ করা তো দূরের কথা, দোকানের নামই রেখে দিলেন—যৌতুক।
তারপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি। কৃষ্ণনাথ রোডের পাশে দিনভর সে দোকানে পানের জন্য লম্বা লাইন। পান তৈরির ফাঁকে টাট্টুও অনায়াসে বলতে পারেন, ‘‘সারা দিনে কত হাজার পান যে বিক্রি হয়, তার কি আর হিসেব রাখা সম্ভব নাকি!’’ এমন কথা বোধহয় টাট্টুর মুখেই সাজে। পান আসে সেই মেচেদা থেকে। ৫৬ বর্গফুট দোকানে রাখা ১৬৫ লিটার ফ্রিজে থরে থরে শুধু পান আর পান। বাড়ির ৩০০ লিটারের ফ্রিজেও তাই।
পান গোলাপ জলে ধুইয়ে তারপর সাজতে বসেন বছর চল্লিশের ওই যুবক। দাম ১২ টাকা থেকে ১৫০ টাকা। কত রকমের যে মশলা তিনি ব্যবহার করেন তা একমাত্র তিনিই জানেন। আর চাহিদা? অনুষ্ঠান বাড়ির মেনুকার্ডে পর্যন্ত ছাপার অক্ষরে লেখা থাকে— শেষপাতে ‘যৌতুকের পান’।
সারাদিনটা বেশ সামলে দেন টাট্টু। কিন্তু আসল ভিড় শুরু হয় রাত সাড়ে সাতটা থেকে সাড়ে ১০টা পর্যন্ত। বয়স্ক লোকজনকে অনুরোধ করলে অপেক্ষা করেন। কিন্তু সামলানো কঠিন হয়ে পড়ত যুবকদের। তাই ভেবেচিন্তে ওয়াই-ফাই চালু করে দিয়েছেন তিনি। দোকানের সামনের ভিড়টার দিকে আঙুল তুলে হাসতে হাসতে টাট্টু বলছেন, ‘‘দেখেছেন, মোবাইলে কেমন ব্যস্ত! কোনও তাড়া নেই। ওরা জালে জড়িয়ে পড়েছে। আমি পানে।’’
বুবাই সিংহ, অভিনব ঘোষ, সুমিত সিংহ, রোহন ভকতরা সমস্বরে বলছেন, ‘‘টাট্টুদা কিন্তু বেড়ে বুদ্ধি বের করেছে। আমাদের পাসওয়ার্ডও দিয়ে দিয়েছে। তবে কোনও দিন এসে ইন্টারনেট সংযোগ না পেলেই বুঝতে পারি পাসওয়ার্ড বদল হয়েছে। তখন নতুন পাসওয়ার্ড জেনে নিই।’’
পাসওয়ার্ড নিয়ে অবশ্য এত কড়াকড়ি নেই আনন্দনগর অশোক স্মৃতি সঙ্ঘে। গ্রামের লোকজন চাইলেই ঢুকে পড়তে পারেন নেট-দুনিয়ায়। ক্লাব চত্বর থেকে ৩০০ মিটার পর্যন্ত ওয়াইফাই পরিষেবা পাওয়া যাচ্ছে। ক্লাবের সম্পাদক পবন সরকারের কথায়, ‘‘বর্তমানে সব কিছুই ক্রমশ নেট-নির্ভর হয়ে পড়ছে। গ্রামের ছেলেমেয়েরাই বা পিছিয়ে থাকবে কেন? আমাদের গ্রামে অন্তত দেড়শো জনেরও বেশি স্মার্ট ফোন ব্যবহার করেন। এই পরিষেবায় সকলেই উপকৃত হবেন। নিজেদের মধ্যে চাঁদা তুলে এই ওয়াই-ফাইয়ের খরচ মেটাবে ক্লাবের সদস্যরাই।’’
ক্লাবের সামনে সিমেন্টের বেঞ্চে মোবাইল হাতে বসেছিলেন স্থানীয় এক কলেজ পড়ুয়া। ফোনটা এসেছিল সন্ধ্যা নাগাদ—‘‘সিন্ধুর পুরো নামটা জানিস?’’
‘‘না জানার কী আছে! পুসারলা বেঙ্কট সিন্ধু।’’ মুহূর্তের মধ্যে জবাব দিয়ে ওই কলেজ পড়ুয়া হাসছেন, ‘‘মেরে পাস ওয়াই-ফাই হ্যায়।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy