আগের ইদে পদ্মার ও পার থেকে ধেয়ে এসেছিল ভয়।
গুলশনের সেই সন্ধ্যা ইদ-উল-ফিতরের আনন্দে ছড়িয়ে দিয়েছিল মনখারাপ।
মঙ্গলবার, বাদলা আকাশের নীচেও ইদুজ্জোহা কিন্তু ভুলিয়ে দিল গত ইদের বিষন্নতা।
সকালে নমাজ, দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পরে কেউ বেরিয়ে গেলেন জলঙ্গির পদ্মাপাড়ে। কেউ মোটরবাইকে বেরিয়ে পড়লেন বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে।
কারও আবার আগে থেকে টিকিট কাটাই ছিল। তাঁরা সপরিবার ছুটলেন বহরমপুরে। ‘আকিরা’, ‘ফ্রিকি আলি’ ও ‘বার বার দেখো’ দেখতে হামলে পড়লেন লোকজন।
তবে দিনভর হইহই চললেও বিশেষ এই দিনে সচেতনতার পাঠও দিয়েছেন মসজিদের ইমাম ও বিশিষ্ট বক্তারা। এ দিন সকালে চাপড়া ইসলামগঞ্জ হাই মাদ্রাসায় নমাজে যোগ দিয়েছিলেন হাজার সাতেক মানুষ।
বিশিষ্ট বক্তা কাজি ফারুক আহমেদ এ দিন নমাজের আগে বলেন, ‘‘সন্ত্রাসবাদকে ইসলাম প্রশ্রয় দেয় না। ইসলাম সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে। কোরানও এটা সমর্থন করে না।’’
তাঁর সংযোজন, ‘‘আমরা সকলেই ভাই ভাই। সকলকেই একসঙ্গে থাকতে হবে। কিছু লোক ইসলামের নাম করে সন্ত্রাস করার চেষ্টা করছে। সে সম্পর্কে আমাদের সজাগ থাকতে হবে। আমরা দেশের জন্য প্রয়োজনে জীবনও দেব।’’
কিন্তু ইদের দিনে এমন সচেতনতার পাঠ কেন?
স্থানীয় বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, ইদের দিন বলেই নয়, নানা বিষয়েই তাঁদের সচেতন করা হয়। কখনও ইমামরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে লোকজনকে নানা বিষয়ে পরামর্শ দেন। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে মসজিদের মাইক থেকেও প্রচার চলে।
নদিয়া ও মুর্শিদাবাদে এর আগেও এমন ঘটনা বহু বার ঘটেছে। তেহট্টে ইমামরা বার্ড ফ্লু-র সময় প্রচার করেছিলেন, মরা ও অসুস্থ মুরগি খাবেন না। থানারপাড়ার এক যুবক খাগড়াগড় বিস্ফোরণে অভিযুক্ত ছিলেন। স্থানীয় মসজিদ থেকে তখনও প্রচার করেছিলেন—ওই যুবকের সন্ধান পেলে পুলিশকে জানান।
পোলিও খাওয়ানো ও নাবালিকার বিয়ে রুখতে পথে নেমেছিলেন হরিহরপাড়া এলাকার ইমামেরা। সম্প্রতি ডোমকল ও হরিহরপাড়ায় ডেঙ্গু নিয়েও সচেতন করেছেন তাঁরা।
চাপ়ড়ার বাসিন্দা বসিরুদ্দিন শেখ বলছেন, ‘‘সময়টা ভাল নয়। ইদ-উল-ফিতরের সময় গুলশনে কী হল দেখলেন তো! ইদের নমাজের সময় একসঙ্গে অনেকে থাকেন। ফলে এই ধরনের সচেতনতার দরকার আছে বইকী।’’
চাপড়ার বেলতলা হাই মাদ্রাসার মাঠে ও কালীগঞ্জের জমপুকুরে ইদগাহেও নমাজের পরে লোকজনকে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সচেতন করতে এগিয়ে এসেছিলেন স্থানীয় ইমাম।
স্থানীয় বাসিন্দা কাজল শেখ বলছেন, ‘‘মানুষ কখনও কখনও না বুঝে ভুল পথে পরিচালিত হয়। সন্ত্রাসবাদীরাও দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে নিরীহ মানুষকে ফাঁসিয়ে দেন। মানুষ সচেতন হলে এই ধরনের বিপদ এড়ানো যায়।’’
ইদ-উল-ফিতরের আগে বাংলাদেশের গুলশনে সন্ত্রাসবাদীদের হামলায় প্রাণ হারিয়ে ছিলেন বেশ কয়েকজন। সেই ঘটনার পরে সতর্কতা বাড়ানো হয়েছিল সীমান্তে। বিএসফের পাশাপাশি সতর্ক ছিল পুলিশও। ফলে ইদ-উল-ফিতরের দিন বিপাকে পড়েছিলেন সীমান্তের লোকজন। জলঙ্গিতে পদ্মার বাঁকে ও নদিয়ার কাছারিপাড়ায় পরবের সময় বহু মানুষ ভিড় করেন। কিন্তু সে বার বিএসএফের সৌজন্যে সে আনন্দে ভাটা পড়ে।
এ বার অবশ্য তেমনটা হয়নি। সকাল থেকেই দু’একবার আকাশে মেঘ জমতেই মুখ ভার হয়ে গিয়েছিল লোকজনের। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বৃষ্টি না হওয়ায় স্বস্তিতেই ছিল দুই জেলা। এ দিন বিকেলে সপরিবার জলঙ্গির বাঁকে এসেছিলেন ডোমকলের জাহির আব্বাস। তাঁর কথায়, ‘‘গত ইদে এখানে এসেও ফিরে যেতে হয়েছিল। গুলশন-কাণ্ডের পরে বিএসএফও কোনও ঝুঁকি নেয়নি। কিন্তু এ বারে দিব্যি সকলকে নিয়ে ঘুরে দেখলাম ভরা পদ্মা। ওপারের চর। তারও ওদিকে বাংলাদেশ।’’
জলঙ্গির মতো কাছারিপাড়াতেও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখার মতো। স্থানীয় বাসিন্দা সন্তোষ জোয়ারদার, শঙ্কর মণ্ডলের মতো কিছু লোকজন উদ্যোগী হয়ে পদ্মার পাড়কে দিব্যি সাজিয়ে তুলেছেন। সেখানে বসার জায়গা থেকে শুরু করে পিকনিকের ব্যবস্থা, এমনকী প্যাডেল বোটেরও ব্যবস্থা আছে। এ দিন সেখানেও ভালই ভিড় ছিল। বিকেলের নরম আলোয় পদ্মার বুকে সেই নৌকায় ঘুরে বেজায় খুশি ইসমাইল শেখ। তাঁর কথায়, ‘‘বাড়ির কাছে এত ভাল জায়গা আছে তা এখানে না এলে জানতেই পারতাম না।’’
তবে এত কিছুর পরেও আক্ষেপ যাচ্ছে না জলঙ্গির বাঁকের চা বিক্রেতা পিন্টু মণ্ডলের। তিনি বলছেন, ‘‘এ আর কী এমন ভিড়! অন্য বছর দম ফেলার সময় পাই না। এক গুলশনই সব শেষ করে দিল। অনেকেই ভয়ে এ বার এ দিকে আসেননি। ভেবেছিলেন, আগের ইদের মতোই বোধহয় ঘুরে যেতে হবে।’’
তাঁর প্রশ্ন, ‘‘সন্ত্রাস করবে মুষ্টিমেয় কিছু লোক। আর তার মাসুল দিতে হবে আমাদের মতো সাধারণ মানুষকে। এমনটা আর কতদিন চলবে?’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy