নিজে দাঁড়িয়ে দশ-বারো কেজির রুই-কাতলা কাটিয়ে আনাটাও বাঙালির প্রিয় বাজার-বিলাস। নিজস্ব চিত্র
চাষি চব্বিশটা মাছ এনে স্ত্রীকে দিয়েছে রান্নার জন্য। রান্নার পর সে মাছ চাখতে গিয়ে প্রায় সবটাই খেয়ে ফেলছেন চাষিবউ।
পড়ে আছে একটা মাত্র মাছ।
অগত্যা উপায়? স্ত্রী খেতে বসে স্বামীকে মাছের হিসাব দিচ্ছেন এইভাবে— “মাছ আনিলা ছয় গণ্ডা, চিলে নিলে দু’গণ্ডা। বাকি রহিল ষোলো, ধুতে আটটা জলে পলাইল। তবে থাকিল আট, দুইটায় কিনিলাম দুই আটি কাঠ। তবে থাকিল ছয়, প্রতিবাসিকে চারিটা দিতে হয়। তবে থাকিল দুই, আর একটা চাখিয়া দেখিলাম মুই। তবে থাকিল এক, এখন হইস যদি ভাল মানুষের পো, কাঁটাখানা খাইয়া মাছ খান থো।”
সম্ভবত মাছ নিয়ে বাংলায় লেখা প্রথম ছড়াটি পাওয়া যায় আদি মধ্যযুগে প্রাকৃত পৈঙ্গলের এই পঙ্ক্তি ক’টিতে, “ওগগরা ভত্তা, গাইক ঘিত্তা, মোইলি মচ্ছা, নালিত গচ্ছা দিজ্জই কান্তা খা (ই)পুনবন্তা।” কলাপাতায় গরম ভাতে গাওয়া ঘি, মৌরলা বা ময়না মাছের ঝোল আর নলিতা (পাট) শাক। মধ্যাহ্নভোজনে বসেছেন পুণ্যবান গৃহকর্তা, পরিবেশন করছেন স্ত্রী। বাঙালির গার্হস্থ্য জীবনের সুখের সময়ের ছবি।
বরিশালের মানুষ বিজয়গুপ্ত তাঁর ‘মনসামঙ্গল’এ নানা মাছের কথা লিখেছেন “মৎস্য কাটিয়া থুইল ভাগ ভাগ। রোহিত মৎস্য দিয়া রান্ধে নলতার আগ। মাগুর মৎস্য দিয়া রান্ধে গিমা গাছ, ঝাঁজ কটু তৈলে রান্ধে খরসুন মাছ। ভিতরে মরিচ গুঁড়ো বাহিরে জুড়ায় সুতা, তৈলে পাক করিয়া রান্ধে চিংড়ির মাথা। ভাজিল রোহিত আর চিতলের কোল। কৈ মৎস্য দিয়া রান্ধে মরিচের ঝোল।” ইশ্বর গুপ্ত লিখছেন— “ভাত মাছ খেয়ে বাঁচে বাঙালি সকল, ধানে ভরা ভূমি তাই মাছ ভরা জল।” এহেন বাঙালির পাল্লায় পরে পলাশির যুদ্ধের পর থেকে ইংরেজরাও মৎস্যভূক। এদেশীয় প্রথায় আদা-লঙ্কা-রসুন-পিঁয়াজ দিয়ে মাছ খেতে শিখতেই সেকালের কবিদের কলমে মাছের ছড়ার ছড়াছড়ি।
শোনা যায়, কাঁটা না থাকায় সাহেবরা প্রথমে ভেটকি, তোপসে, চিংড়ি জাতীয় মাছ বেশি খেতেন। আদুরে ব্রিটিশ-উচ্চারণে ভেটকি হয়েছিল ‘বেকটি’! আমের মরসুমে মিলত বলে সাহেবরা তোপসে মাছকে ‘ম্যাঙ্গো ফিস’ বলতেন। ঈশ্বর গুপ্ত লিখলেন, “এমত অমৃত ফল ফলিয়াছে জলে, সাহেবরা তাই সুখে ম্যাঙ্গো ফিস বলে।”
শিশুপাঠ্যেও মাছ নিয়ে অজস্র চেনা ছড়া। “দাদা ভাই চাল ভাজা খাই, ময়না মাছের মুড়ো” বা “খোকা গেল মাছ ধরতে ক্ষীর নদীর কূলে” কিংবা “গলদা চিংড়ি তিংরি মিংরি”র মতো প্রচলিত ছড়া এই সময়ের ছোটদের বই থেকে সরে যাচ্ছে ক্রমশ। আবার, “অল্পেতে খুশি হবে দামোদর শেঠকি, মুড়কির মোয়া চাই চাই ভাজা ভেটকি” লিখে ছন্দ মেলান রবীন্দ্রনাথ। কিংবা সত্যেন্দ্রনাথের কবিতায় ‘ইলশে গুঁড়ির নাচন দেখে, নাচছে ইলিশ মাছ’এর মতো কিছু পঙ্ক্তি লোকের মুখে মুখে ফিরত একসময়।
প্রসেস্ড ফুড-এ অভ্যস্ত এই সময়ে দেশি মাছের মতো স্মৃতি থেকে মুছে যাচ্ছে এই সব মাছের ছড়াও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy