“মাহ শাওন/ করিব ঝুলন/ লাড়িলি কুণ্ডের তীরে। মণ্ডলী মণ্ডলী/ সহচরী মিলি/ কিশোরীকে করি সঙ্গে। নাচিব গাহিব/ ঝুলিব ঝুলাব/ বিহরিব মনোরঙ্গে।”
বৈষ্ণব পদাবলির এই সুরে সুর মিলিয়ে ঝুলন-রঙ্গে মেতে উঠেছে নবদ্বীপ এবং গঙ্গার পূর্বপাড়ে মায়াপুর। পঞ্জিকার হিসেবে ঝুলন পাঁচ দিনের উৎসব। কিন্তু নবদ্বীপের সব কিছুই স্বতন্ত্র। ঝুলন উৎসব শুরু হয় শ্রাবণের শুক্লা প্রতিপদ থেকে। চলে পনেরো দিন ধরে। রাস বা দোলের মতো নয়, পাঁচ দিনের ঝুলনযাত্রা বর্ণময়তা, বৈচিত্র্যে এক ভিন্ন মেজাজের উৎসব। ছোট বড় মঠমন্দির থেকে শুরু করে ক্লাব বারোয়ারি এমনকী ব্যক্তিগত উদ্যোগেও ঝুলন উদ্যাপন হয় খুব আড়ম্বরে। উৎসব এবং পর্যটন নির্ভর ব্যবসা বাণিজ্যকে বর্ষা মরসুমে বেশ খানিকটা রসদ জোগায় এই ঝুলন।
একসময় নবদ্বীপের মানুষ ঝুলন তার আঙ্গিকের জন্য ছিল বিখ্যাত। জনবহুল পথের মোড় বদলে যেত নাট্যমঞ্চে। রাস্তা থেকে অনেক উঁচুতে বাঁধা হত মঞ্চ। ঠিক পিছনেই মণ্ডপ। সে মঞ্চের যবনিকা ওঠার অপেক্ষায় পথে তখন থিকথিকে ভিড়। চারপাশে মেলার পরিবেশ। নির্দিষ্ট সময়ে প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে উঠত পর্দা। নিভে যেত চারপাশের আলো। শুরু হত অভিনয়। দশ থেকে পনেরো মিনিটের নাট্যাংশ। পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারতের গল্প থেকে সাম্প্রতিক উল্লেখযোগ্য ঘটনা—সবই থাকতে পারে। এই ‘মানুষ ঝুলন’ নবদ্বীপের নিজস্ব উদ্ভাবন, যা রাধাকৃষ্ণময় বৈষ্ণবীয় উৎসবকে ভিন্ন মাত্রা দেয়।
মঠমন্দিরে কিন্তু ঝুলনের ভিন্ন মেজাজ। গোবিন্দবাড়ি, বলদেববাড়ি, গোরাচাঁদের আখড়া, রাধা মদনমোহন মন্দির, মোহন্তবাড়ি, জন্মস্থান আশ্রম উৎসব মুখর। মহাপ্রভু মন্দির, সমাজ বাড়িতে উৎসব শুরু অনেক আগে। মহাপ্রভু মন্দিরের ঝুলনের উৎসব চলে প্রতিপদ থেকে পূর্ণিমা—এক পক্ষকাল। চৈতন্যদেবকে রাধাকৃষ্ণের মিলিত তনু বলা হয়। রাধাকৃষ্ণের লীলা তাঁর মাধ্যমে নবদ্বীপে নতুন রূপ লাভ করেছিল। তাই নবদ্বীপ গুপ্ত বৃন্দাবন। ফলে ঝুলন এখানে রাধাকৃষ্ণের নয় মহাপ্রভুর। মন্দির ভেদে বদলে যায় উদযাপনের আঙ্গিক। পাঁচদিনের ঝুলন উপলক্ষে কীর্তন ও পাঠের আসর বসে। নবদ্বীপ হরিসভা মন্দিরের প্রধান বিবেকবন্ধু ব্রহ্মচারী বলেন, “ঝুলনের শেষ পাঁচদিন মহাপ্রভুকে সাজানো হয় পাঁচটি বিশেষ বেশে।’’ একাদশীর দিন নটবর বেশ, দ্বাদশীর দিন নাটুয়া বেশ, ত্রয়োদশীর রাখাল বেশ, চতুর্দশীর দিন নাগরী বেশ এবং পূর্ণিমার দিন রাজবেশ।” সমাজবাড়ির ঝুলন তেরো দিনের। বৃন্দাবনের গোস্বামী মতে, এখানে ঝুলনযাত্রা উদ্যাপন করা হয়। প্রতিপদ থেকে দশমী পর্যন্ত হয় সায়ংকালীন ঝুলন। আর একাদশী থেকে পূর্ণিমা পর্যন্ত সারারাত ঝুলন কীর্তন হয়। সঙ্গে সখী বেশে লীলা অভিনয়। কীর্তনে যেমনটি বলা আছে তাই অভিনীত হয়। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান, নবদ্বীপের ঝুলন শারদ উৎসবের মহড়া। বৈষ্ণবতীর্থের ঝুলনের রূপরস আস্বাদন করতে বর্ষায় যেমন পর্যটক আসেন তেমনই মণ্ডপ থেকে আলোশিল্পী সকলে শেষবারের মতো নিজেদের প্রস্তুতি ঝালিয়ে নেন। পাঁচ দিনের ঝুলনে সেই চেনা শারদ উৎসবের গন্ধ ভেসে বেড়ায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy