Advertisement
২৩ মে ২০২৪

তৃণমূল কর্মী খুন, উত্তপ্ত বহরমপুর

পুরভোটের দিন, শনিবার সকাল থেকে নিখোঁজ ছিলেন বহরমপুর লাগোয়া তারাকপুরের বাসিন্দা ইমান শেখ (৪২)। রবিবার সকাল সাড়ে ১০টা নাগাদ স্থানীয় পঞ্চাননতলার কাছে কারবেলা রোডে একটি তিনতলা বাড়ির নিচের তলার গুদামে বস্তা চাপা দেওয়া অবস্থায় তাঁর দেহ উদ্ধার হয়। এলাকায় ইমান দাপুটে কর্মী হিসেবে পরিচিত ছিলেন দাবি তৃণমূলের।

পুলিশকে ঘিরে বিক্ষোভ তৃণমূল কর্মীদের। বহরমপুরে গৌতম প্রামাণিকের তোলা ছবি।

পুলিশকে ঘিরে বিক্ষোভ তৃণমূল কর্মীদের। বহরমপুরে গৌতম প্রামাণিকের তোলা ছবি।

শুভাশিস সৈয়দ
বহরমপুর শেষ আপডেট: ২৭ এপ্রিল ২০১৫ ০০:৩৯
Share: Save:

পুরভোটের দিন, শনিবার সকাল থেকে নিখোঁজ ছিলেন বহরমপুর লাগোয়া তারাকপুরের বাসিন্দা ইমান শেখ (৪২)। রবিবার সকাল সাড়ে ১০টা নাগাদ স্থানীয় পঞ্চাননতলার কাছে কারবেলা রোডে একটি তিনতলা বাড়ির নিচের তলার গুদামে বস্তা চাপা দেওয়া অবস্থায় তাঁর দেহ উদ্ধার হয়। এলাকায় ইমান দাপুটে কর্মী হিসেবে পরিচিত ছিলেন দাবি তৃণমূলের। মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়তেই এলাকা কার্যত রণক্ষেত্র হয়ে ওঠে। প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ অনুমান, ব্যবসা সংক্রান্ত কারণে ওই তৃণমূল কর্মীকে শ্বাসরোধ করে খুন করার পরে তাঁর শরীর ধারালো অস্ত্র দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছে। মুর্শিদাবাদের পুলিশ সুপার সি সুধাকর বলেন, “ব্যবসায়িক কারণে ওই খুন বলে অনুমান। ঘটনায় একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।”

যাঁর বাড়ি থেকে ওই তৃণমূল কর্মীর দেহ মিলেছে, সেই আবদুল হালিম ওরফে ভুট্টুকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। ভুট্টু শনিবার সকালে ফোন করে ইমানকে ডেকে পাঠায় বলেও পুলিশ জেনেছে। ধৃত ওই ব্যক্তি ‘কংগ্রেস কর্মী’ বলে তৃণমূলের দাবি। ফলে রাজনৈতিক কারণে কংগ্রেস আশ্রিত দুষ্কৃতীরা দলীয় কর্মীকে খুন করা হয়েছে বলে তৃণমূল নেতৃত্বের অভিযোগ। জেলা তৃণমূলের সভাপতি মান্নান হোসেন বলেন, “মুর্শিদাবাদ জেলায় নতুন করে খুনের রাজনীতি কায়েম করার চেষ্টা চলছে। কংগ্রেসের পায়ের তলায় মাটি সরে যাচ্ছে বলেই খুন-সন্ত্রাসের পরিবেশ আমদানি করছে তারা।” খুনের ঘটনায় জড়িত অভিযোগে পুলিশ যাকে গ্রেফতার করেছে, সেই ভুট্টু মুর্শিদাবাদ জেলা পরিষদের সভাধিপতির কাছের লোক বলেও মান্নানবাবুর দাবি।

অভিযোগ উড়িয়ে জেলা পরিষদের সভাধিপতি কংগ্রেসের শিলাদিত্য হালদারের পাল্টা তোপ, “বহরমপুর ব্লকের ধনাইপুর গ্রামের বাড়িতে ভুট্টু সিপিএম করত। বহরমপুরে এসে ব্যবসার কারণে তৃণমূলে নাম লিখিয়েছে। সকলেই জানেন পোট্রোল পাম্প সংক্রান্ত কারণে ওই খুন। যে খুন হয়েছে এবং যারা খুন করেছে, সকলেই তৃণমূলে। পুরভোটের ফল কংগ্রেসের পক্ষে যাবে, তা বুঝে মান্নান হোসেন এখন প্রলাপ বকছেন!”

এ দিকে, যে বাড়ি থেকে তৃণমূল কর্মীর দেহ উদ্ধার হয়, সেই বাড়ি ভাঙচুর করে আগুন ধরিয়ে দেয় তৃণমূলের লোকজন। জানলা দিয়ে গলগল করে ধোঁয়া বের হতে থাকে। খবর পেয়ে দমকল দফতরের গাড়ি আগুন নেভাতে এলে তাদের এলাকায় ঢুকতে বাধা দেয় তারা। পরে অবশ্য দমকল দফতরের গাড়ি দুটি আগুন নেভায়। দেহ উদ্ধারে গেলে তৃণমূল কর্মীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট-বৃষ্টি শুরু করে। ইটের আঘাতে আহত হন বহরমপুর থানার আইসি অরুণাভ দাস, টাউন সাব-ইন্সপেক্টর রবি মালাকার ও সাব-ইন্সপেক্টর সন্দীপ সেন। এ প্রসঙ্গে মান্নান জানান, তৃণমূল কর্মীদের সঙ্গে সাধারণ গ্রামবাসী কদবেলতলায় ভিড় করেন। কয়েক হাজার মানুষ ছিলেন। তাঁরা আবেগ তাড়িত হয়ে পুলিশের উপরে চড়াও হন। ‘‘পুলিশকে মারধর করা ঠিক হয়নি’’—মানছেন মান্নান।

এর মাঝে দলীয় পতাকা হাতে তৃণমূল কর্মীরা বহরমপুর-জলঙ্গি রাজ্য সড়কের উপরে বেঞ্চ পেতে অবরোধ করে। বেসরকারি বাসেও ভাঙচুর চালায় তারা। বাস থেকে নিরীহ যাত্রীদের নামিয়ে মারধর করা হয় বলেও অভিযোগ। ঘণ্টা খানেক তাণ্ডব চলে। পরে বিশাল পুলিশ বাহিনী গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। তখন মান্নান হোসেনকেও দলীয় কর্মী-সমর্থকদের শান্ত করতে দেখা গিয়েছে।

পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, বছর দুয়েক আগে বহরমপুর-জলঙ্গি রাজ্য সড়কের ধারে পেট্রল পাম্প কেনার জন্য ছয়ঘরির হাজি নাজিনুর ইসলাম ও ভুট্টুর সঙ্গে মালিকের যে চুক্তি হয়েছিল, তার তুলনায় জলের দরে মালিকের কাছ থেকে তারা ওই পেট্রল পাম্প জোর করে নিজেদের নামে লিখিয়ে নেয় বলে অভিযোগ। ইমানের ভাগ্নে রেজাউল শেখ বলেন, “তখন ওই পাম্প মালিক মামাকে পাওনা টাকা উদ্ধার করার জন্য বলে। রফাসূত্র বের করতে সব পক্ষকে নিয়ে ২০১৩ সালের নিয়ামত শেখের বাড়িতে আলোচনা হয়। সিদ্ধান্ত হয়, আগামী চার মাসের মধ্যে বকেয়া মিটিয়ে দিয়ে ব্যাঙ্কের হেফাজত থেকে পাম্পের কাগজ ছাড়িয়ে নিয়ে আসবেন মালিক। পরে আইন মতো ওই দুজনের নামে পাম্প হস্তান্তর করা হবে।”

সেই মতো দু’পক্ষের মধ্যে লিখিত হয়। কিন্তু অভিযোগ তারপরেও পাওনা টাকা মিটিয়ে দেওয়ার কোনও আগ্রহ দেখায়নি ওই দুজন। এ দিকে ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ ওই পেট্রল পাম্প বাজেয়াপ্ত করে নিলামে বিক্রিও করে দেয়। পাম্প কেনার জন্য মালিককে দেওয়া কয়েক লক্ষ টাকা আদায়ের জন্যই শনিবার সকালে ভুট্টু ফোন করে ডেকে পাঠায় বলে পরিবারের লোকজন জানান।

দুপুর পেরিয়ে গেলেও ইমান বাড়ি না ফেরায় খোঁজ শুরু হয়। রেজাউল জানান, ভুট্টুকে মামার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে ‘জানি না’ বলে জানায়। তার কথাবার্তা সন্দেহ হওয়ায় ভুট্টুকে তারাকপুর গ্রামে তুলে নিয়ে গিয়ে একটি দোকান ঘরে বন্দি করে রাখা হয়। পরে বিকেলের দিকে বহরমপুর থানার পুলিশকে ডেকে ভুট্টুকে তাদের হাতে তুলে দিই।

পুলিশের দাবি, জেরায় ভুট্টু স্বীকার মেনেছে তাঁর গুদামে ইমানের দেহ রাখা আছে। তা জেনে পরিবারের লোকজন ও তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকরা গুদামের তালা ভেঙে দেহ উদ্ধার করে। দেহ উদ্ধারের পরে কদবেলতলার বাড়ি ভাঙুচরের পাশাপাশি ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের পাশে প্রফেসর পাড়ার বাড়িতে ভাঙচুর চালানো হয়। এ দিকে শনিবার সন্ধ্যায় সন্তানদের নিয়ে ওই বাড়ি ছেড়ে পালায় ভুট্টুর স্ত্রীও। ঘটনার পর থেকে পলাতক দৌতলতাবাদ থানার ছয়ঘরির বাসিন্দা হাজি নাজিনুর ইসলামও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE