সুতির উমরাপুরে উল্লাপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শেখপাড়া পর্যন্ত এই কাঁচা রাস্তাকে মোরামের রাস্তা দেখানো হয়েছে। —নিজস্ব চিত্র।
ফরাক্কার পরে এ বার সুতির উমরাপুর।
মাস কয়েক আগে রেডিওতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ‘মন কি বাত’ শুনে এলাকার স্কুলের দুরবস্থার কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দফতরে চিঠি পাঠিয়েছিলেন ফরাক্কার জনাকয়েক অভিভাবিকা। তাতে ফলও মিলেছিল। এ বার সুতি ২ ব্লকের উমরাপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে স্থানীয় বাসিন্দারা সম্প্রতি চিঠি পাঠালেন প্রধানমন্ত্রীর দফতরে। গ্রামের বাসিন্দাদের পাশাপাশি ওই চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন কংগ্রেস ও সিপিএমের স্থানীয় নেতারাও।
পঞ্চায়েতের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ। অথচ বিডিও কিংবা জেলা প্রশাসনকে বাদ দিয়ে সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর দফতরে অভিযোগ কেন? স্থানীয় কংগ্রেস নেতা গোলাম নাসের বলছেন, ‘‘একশো দিনের কাজে গত দু’বছরে বরাদ্দ প্রায় ১.৬৩ কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে। আর তা থেকে বাঁচতে সুতি ২ ব্লকের উমরাপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের ওই প্রধান রবিকুল ইসলাম তাঁর অনুগামীদের নিয়ে তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন। ফলে এই দুর্নীতির তদন্তের ব্যাপারে ব্লক ও জেলা প্রশাসনের উপরে আমাদের আস্থা নেই।’’ সুতি ২ বিডিও দীপঙ্কর রায় তৃণমূল নিয়ন্ত্রিত উমরাপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলেও এই বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি।
সিপিএম নেতা জহরুল হক জানান, একশো দিনের কাজের প্রকল্পটি কেন্দ্রীয় সরকারের। রাজ্য সরকার বার বার দাবি করেছে সেই কাজে পশ্চিমবঙ্গের সাফল্যের কথা। মুর্শিদাবাদের প্রত্যন্ত এলাকা উমরাপুরের সেই কাজের সাফল্য কতটা তা এ বার প্রধানমন্ত্রী নিজে চোখেই দেখতে পাবেন। এই এলাকা থেকেই ভোটে জিতে একসময় সাংসদ হয়েছিলেন বর্তমান রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। তিনি নিজেও এই গ্রামে বেশ কয়েকবার এসেছেন। তাই প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো অভিযোগের প্রতিলিপি পাঠানো হয়েছে রাষ্ট্রপতির কাছেও। জহরুল বলছেন, ‘‘আশা করি এই দুর্নীতির যথাযথ তদন্ত করে কেন্দ্রীয় সরকার উপযুক্ত ব্যবস্থা নেবে।’’
এর আগে প্রধানমন্ত্রীর ‘মন কি বাত’ অনুষ্ঠান শুনে ফরাক্কা ব্যারাজ হাই স্কুলের শিক্ষক সঙ্কটের কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দফতরে চিঠি পাঠিয়েছিলেন ফরাক্কার প্রায় ৭২ জন মহিলা অভিভাবক। তারপরেই নড়েচড়ে বসে কেন্দ্রীয় জল সম্পদ মন্ত্রক। স্কুলটি তাদের নিয়ন্ত্রণেই চলে। ওই ঘটনার পরে স্কুলে ১০ জন শিক্ষককে নিয়োগের নির্দেশ আসে দিল্লি থেকে। উমরাপুরের বাসিন্দারাও চিঠিতে প্রধানমন্ত্রীকে লিখেছেন ‘‘রেডিওতে আপনার অনুষ্ঠান আমাদের মন ছুঁয়ে গিয়েছে। আপনার কথা আমাদের অনুপ্রাণিত করেছে। সেই কারণেই আমরা আপনার সহযোগিতা চাই। যাতে এই দুর্নীতির উপযুক্ত তদন্তের ব্যবস্থা করা হয়।’’
ওই অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, ২০১৪-১৫ অর্থবর্ষে উমরাপুর পঞ্চায়েত এলাকায় ১০টি মোরাম রাস্তা তৈরি হয়েছে বলে ৪৯টি ভাউচার তৈরি করে ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পে ৮২.৪০ লক্ষ টাকা খরচ দেখানো হয়েছে। এই টাকা তোলা হয়েছে দু’টি রাস্তা নির্মাণকারী ঠিকাদারি সংস্থার নামে। ওই দুই সংস্থার একটির মালিক তৃণমূলের পঞ্চায়েত প্রধানের বোন ও ভগ্নিপতি। অন্য সংস্থাটির মালিক তৃণমূলেরই এক পঞ্চায়েত সদস্যের ভাইপো।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, যে ১০টি মোরাম রাস্তার নির্মাণ দেখিয়ে এই ৮২ লক্ষ টাকা তোলা হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে ডিবিএস হাই মাদ্রাসা থেকে শেখপাড়া পর্যন্ত একটি রাস্তা। ওই রাস্তাটি বছর দুয়েক আগেই পিচ করা হয়েছে এবং গ্রামবাসীরা তা ব্যবহারও করছেন। কাজেই ওই রাস্তা মোরাম করার প্রশ্নই ওঠে না। একই ভাবে উল্লাপাড়া স্কুল থেকে শেখপাড়া মোড় পর্যন্ত সড়কটি নির্মাণে ৪ লক্ষ ৯১ হাজার টাকা খরচ দেখিয়ে সে টাকা তোলা হয়েছে। অথচ রাস্তাটি আজ পর্যন্ত কখনই মোরাম করা হয়নি। এখনও সেটি মাটির রাস্তা হিসেবেই ব্যবহার হচ্ছে। কাঁদোয়া সেতু থেকে বাঁশলই ঘাট পর্যন্ত রাস্তাটি মোরাম করা হয়েছে দেখিয়ে ৬ টি ভাউচারে তুলে নেওয়া হয়েছে ৯ লক্ষ ৯২ হাজার টাকা। অথচ ওই রাস্তাটিও মাটির। একই অবস্থা অন্যান্য সড়কগুলিরও। একই ভাবে ২০১৫ -১৬ অর্থবর্ষে খনন ও জমি ভরাটের ২৭টি কাজ দেখিয়েও ৮১ লক্ষ টাকা তোলা হয়েছে বলে অভিযোগ।
পুকুর খনন ও জমি ভরাটের ক্ষেত্রেও দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। তাঁদের অভিযোগ, গ্রামের ৬৬ ও ৬৯ নম্বর দাগে ১১-১২ অর্থবর্ষে পুকুর খনন করা হয়েছিল। আবার ওই একই দাগে ২০১২-১৩ ও ২০১৫-১৬ অর্থবর্ষেও ফের সেই পুকুর খনন দেখানো হয়েছে। এখানেই শেষ নয়। ওই দাগেই ওই জমিটি ফের মাটি ভরাট করা হয়েছে দেখিয়ে তোলা হয়েছে ৩ লক্ষ টাকা। আর্থিক বেনিয়মের অভিযোগ উঠেছে নির্মাণ কাজেও। গ্রামবাসীরা সমস্ত অভিযোগের নথিপত্রও পাঠিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর কাছে।
সংশ্লিষ্ট গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান রবিকুল ইসলাম অবশ্য বলেন, ‘‘সব অভিযোগই মিথ্যে। তদন্ত হলে হবে। এসব সিপিএম ও কংগ্রেস মিলে চক্রান্ত করে তৃণমূলের বদনাম করতে চাইছে।’’ সুতির বিধায়ক তৃণমূলের ইমানি বিশ্বাস বলেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রীর কাছে অভিযোগ পাঠানোর কথা আমি জানি। উমরাপুরের ওই প্রধান আগে সিপিএম করতেন। এখন তৃণমূল করেন। নির্বাচনের আগে সিপিএম ও কংগ্রেস মিলে লোককে খেপিয়ে এসব চক্রান্ত করছে। তদন্ত হোক। আমরা এ ব্যাপারেও অভিযুক্ত প্রধানকে কোনও রকম সাহায্য করব না। তদন্তে দুর্নীতি প্রমাণ হলে সরকার ব্যবস্থা নেবে।’’ গ্রামবাসীরা অবশ্য প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে কী জবাব আসে তার অপেক্ষায় রয়েছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy