খানাখন্দে ভরা রাস্তায় এ ভাবেই নিত্য যাতায়াত। —নিজস্ব চিত্র।
আর যাওয়া গেল না। অনেক সাধ্যি সাধনা করে দোল খেতে খেতে কোনও মতে দু’কিলোমিটার পথ পাড়ি দেওয়া সম্ভব হয়েছে। তারপর আর না। আরও দু’কিলোমিটার পেরিয়ে গন্তব্যস্থল লালগোলা থানার প্রত্যন্ত এলাকার কুলগাছি-বটতলা গ্রামে কিছুতেই গেল না গাড়ি। চালকের সাফ কথা, “আর এক ধাপও গাড়ি এগোনো যাবে না। রাস্তার যা হাল তাতে আর এগোলেই হয় ইঞ্জিন বিগড়োবে, নয়তো টায়ার পাংচার হবে। কাছে-পিঠে কোনও মেকানিক মিলবে না। তখন অচল গাড়ি নিয়ে পথেই পড়ে থাকতে হবে।”
ময়ার পাশেই রয়েছে লালগোলা থানার নশিপুর গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকা। পণ্ডিতপুর মোড় থেকে নশিপুর গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকাগামী সড়কপথের দুর্দশাও একইরকম। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে প্রসূতিরাও হাসপাতালে না গিয়ে প্রসব করছেন বাড়িতে। সেই জন্য সম্প্রতি স্থানীয় তিন জন ‘অক্সজুলিয়ারি নার্সিং মিড ওয়াইফরি’ সংক্ষেপে এএনএম-কে স্বাস্থ্য দফতর থেকে ‘শো-কজ’ করা হয়েছে। ময়া পঞ্চায়েতের নতুন চিন্তামণি গ্রামের নাজিবুর রহমানের বাড়ি বেহাল সড়ক পথের পাশেই। নাজিবুর বলেন, “খানাখন্দে ভরা পথ। ওই পথ দিয়ে নিয়ে যাওয়া হলে প্রসূতি আর হাসপাতালে পৌঁছবে না। পথেই জীবন শেষ। এই কারণে বছরখানেক থেকে এই তল্লাটের প্রসূতিদের অনেকেরই বাড়িতে প্রসব হচ্ছে।”
লালগোলা-জঙ্গিপুর রাজ্য সড়কের উপর পণ্ডিতপুর মোড়। ময়া পঞ্চায়েত এলাকার ওই মোড় থেকে ১ কিলোমিটার দূরে ফতেপুর মোড়। ফতেপুর মোড় থেকে ডান হাতে চলে গিয়েছে নশিপুর গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার পুটেপাড়া, ইলমপুর, চমকপুর, কুলগাছি-বটতলা। কুলগাছি-বটতলা থেকে ডান হাতে আরও একটি রাস্তা বের হয়ে চলে গিয়েছে রঘুনাথগঞ্জের লক্ষ্মীজোলা গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার দিকে। ফতেপুর মোড় থেকে বাঁ দিকের রাস্তাটি চলে গিয়েছে নশিপুর পঞ্চায়েতের নতুনদিয়াড়, চামিণ্ডা, সিংঘি, কদমতলা, জনার্দনপুর-সহ বিভিন্ন গ্রামে।
জনবহুল ওই এলাকায় যাতায়াতের জন্য বছর নয়েক ধরে পণ্ডিতপুর মোড় থেকে চলাচল করে যন্ত্রচালিত রিকশা ভ্যান, চার চাকার গাড়ি (স্থানীয় ভাষায় ‘জিও’ ও ‘ম্যাজিক’) এবং ঘোড়ার গাড়ি মিলিয়ে মোট ৭৫টি যাত্রীবাহী যানবাহন। ওই রুটের গাড়ি যাতায়াতের দেখভাল (লাইনম্যান) করেন আবু সামাদ। তিনি বলেন, “রাস্তার দুর্দশার কারণে বছর খানেকের মধ্যে যাত্রীবাহী যানবাহনের সংখ্যা ৭৫ থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ৩৫টি।”
ব্যবসায়িক লেনদেন ও যোগাযোগের সুবাদে পণ্ডিতপুর মোড় গঞ্জের আদল পেয়েছে। পণ্ডিতপুর মোড়েই রয়েছে আসলাম শেখ নামে এক যুবকের চায়ের দোকান। আসলাম বলেন, “বছর তিনেকে হল পিচ পাথর উঠে গিয়ে এ তল্লাটের রাস্তা পায়ে হাঁটারও অযোগ্য। ফলে পণ্ডিতপুর মোড়ের বাজারে খদ্দের নেই। বছর খানেকের মধ্যে এই বাজারের বেচাকেনা কমে অর্ধেকে দাঁড়িয়েছে।” ওই বেহাল সড়ক পথের উপর নির্ভরশীল দু’টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের আর্থিক লেনদেন, হাইস্কুল ও হাইমাদ্রাসা মিলিয়ে ৭টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পঠনপাঠন। বেহাল রাস্তার কারণে ধুঁকছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে আর্থিক প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত সব কিছুই। খোদ লালগোলা পঞ্চায়েত সমিতির সহকারী সভাপতি তথা কংগ্রেসের লালবাগ মহকুমা সভাপতি সুজাউদ্দিন বলেন, “আমি পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি থাকাকালীন ২০০৫-২০০৬ অর্থবর্ষে প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনায় পণ্ডিতপুর মোড় থেকে রেয়ানপুর-খামারপাড়া পর্যন্ত ১৩ কিলোমিটার সড়কপথ পিচ-পাথর দিয়ে মুড়িয়ে দেওয়া হয়। ওই বছরই পণ্ডিতপুর মোড় থেকে কুলগাছি-বটতলা যাওয়ার ৪ কিলোমিটার সড়কপথেরও সংস্কার হয়েছিল। তারপর ২০০৮-২০১৩ পর্যন্ত ৫ বছর লালগোলা পঞ্চায়েত সমিতি ও মুর্শিদাবাদ জেলা পরিষদ ছিল সিপিএমের দখলে। কিন্তু ওই ৫ বছরে রাস্তার কোনও রকম সংস্কার হয়নি। ফলে সড়কপথ দু’টিতে এখন সাইকেলও চালানো যায় না।” ওই পথের উপর নির্ভরশীল ৩টি গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার কয়েক লক্ষ মানুষের ভোগান্তির শেষ নেই।
তবে আশার কথা শুনিয়েছেন কংগ্রেসের দখলে থাকা মুর্শিদাবাদ জেলা পরিষদের সভাধিপতি শিলাদিত্য হালদার। তিনি বলেন, “পণ্ডিতপুর মোড় থেকে রেয়ানপুর-খামারপাড়া পর্যন্ত ১৩ কিলোমিটার সড়কপথ সংস্কার করতে প্রায় দেড় কোটি টাকার একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। অল্প দিনের মধ্যে কাজ শুরু করা হবে।” কংগ্রেসের দখলে থাকা লালগোলা পঞ্চায়েত সমিতির সভানেত্রী দীপশিখা হালদার বলেন, “পণ্ডিতপুর থেকে কুলগাছি-বটতলাগামী রাস্তার সংস্কারের জন্য স্থানীয় সাংসদ অভিজিত্ মুখোপাধ্যায়ের প্রচেষ্টায় সীমান্ত এলাকা উন্নয়ন প্রকল্প থেকে অতিরিক্ত বরাদ্দ হিসাবে ৪৮ লক্ষ টাকা পাওয়া গিয়েছে। কিছু দিনের মধ্যে কাজ শুরু করে দেওয়া হবে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy