দুর্ঘটনার পরে ঘটনাস্থলে পুলিশ। ছবি: অর্কপ্রভ চট্টোপাধ্যায়।
রাস্তার উপর ঘুমন্ত ন’জনের উপর দিয়ে চলে গেল লরি। সোমবার ভোরে মুর্শিদাবাদের রঘুনাথগঞ্জ থানার মথুরাপুরের কাছে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কে মর্মান্তিক এই দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে পাঁচ জনের। আহত আরও চার জনকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় বহরমপুরে মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। হতাহতরা সকলেই মুর্শিদাবাদের নওদা থানা এলাকার বাসিন্দা।
একটি ছোট ৪০৭ লরিতে কৃষ্ণনগর থেকে বিভিন্ন ফলের চারা গাছ বোঝাই করে ফরাক্কায় নিয়ে যাচ্ছিলেন নওদার ওই বাসিন্দারা। রাত আড়াইটে নাগাদ মথুরাপুর গ্রামের কাছে লরিটি খারাপ হয়। লরিতে চালক ও খালাসি-সহ ১৭ জন যাত্রী ছিলেন। ফাঁকা মাঠের মধ্যে রাতের বেলা লরি সারানোর কোনও মিস্ত্রি পাওয়া যায়নি। দিনের আলো ফোটার অপেক্ষায় লরিটিকে সড়কের বাঁ দিকে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। খালাসি-সহ দু’জন লরির মধ্যেই সিটের উপর গিয়ে শুয়ে পড়েন। দাঁড় করানো লরিটির ঠিক সামনে রাস্তার উপর ত্রিপল পেতে ঘুমিয়ে পড়েন নয় জন। বাকিরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গল্প করছিলেন। রাত ৩টে নাগাদ বহরমপুরের দিক থেকে আসা একটি বড় লরি দাঁড়িয়ে থাকা লরিটিকে পিছনে ধাক্কা মারে। ঠেলা খেয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট লরিটি পিষে দেয় সামনে ঘুমিয়ে থাকা ন’জনকেই। দুর্ঘটনাগ্রস্তদের আর্ত চিৎকারে একটু দূরে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক নির্মাণকারী সংস্থার অফিস থেকে একটি গাড়ি নিয়ে লোকজন ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন। ন’জনকেই জঙ্গিপুর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তাদের গাড়িতে। চার জন ততক্ষণে মারা গিয়েছেন। ভর্তির আধ ঘণ্টার মধ্যেই মৃত্যু হয় আরও একজনের। বাকি চার জনের অবস্থাও আশঙ্কাজনক। তাঁদের প্রথমে জঙ্গিপুর ও পরে বহরমপুরে মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
মৃতদের মধ্যে এরশাদ মল্লিক (৪০) বাঘাছড়া ও আরমান মণ্ডল (৩১) দুর্গাপুর গ্রামের বাসিন্দা। মৃত বাবলু শেখ (৫৩) চণ্ডীপুর গ্রামের বাসিন্দা। মৃত কাশেম মণ্ডল (৪৫) ও মানিফ শেখের (৪২) বাড়ি রায়পুর গ্রামে। গুরুতর আহতদের মধ্যে তোজাম শেখ, আলতাফ শেখ ও জাহাঙ্গির শেখরা সহোদর ভাই। তাঁদের বাড়ি দুর্গাপুর গ্রামে। আর এক জখম মোজাম্মেল শেখের বাড়ি গাদিগাছা গ্রামে।
দাঁড়িয়ে থাকা লরির কেবিনে ঘুমিয়ে ছিলেন রিন্টু শেখ। তাঁর বাবা বাবলু শেখ শুয়েছিলেন রাস্তার উপর। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় তাঁর। তিনি বলেন, “খুব ক্লান্ত ছিলাম। তাই আমি আর লরির খালাসি গাড়ির কেবিনে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সবে চোখ বুজেছে, হঠাৎই গাড়িটা জোর ধাক্কা খেয়ে গড়াতে শুরু করল। পাশেই গর্তের মধ্যে গড়িয়ে পড়ে লরিটি। তখনও বুঝতে পারিনি কিছু। কেবিন থেকে বেরিয়ে দেখি লরিতে পিষ্ট সকলের রক্তে ভেসে যাচ্ছে চারিদিক।”
টেলিফোনে হতাহতদের বাড়িতে খবর দেন সঙ্গীরা। ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই বাড়ির লোকজন পৌঁছে যান জঙ্গিপুর হাসপাতালে। কান্নার রোল ওঠে হাসপাতালে। মৃত ও আহতদের পরিজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গিয়েছে, সকলে দিনমজুর পরিবারের। বছরে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ভাবে রোজগার করেন তাঁরা। বর্ষার সময় প্রতি বছরই কয়েকজন মিলে জোট বেঁধে আম, লিচু-সহ বিভিন্ন ফলের চারা নদিয়ার কৃষ্ণনগরের নার্শারি থেকে কিনে নিয়ে ফরাক্কায় যান। সেখান থেকে ঝাড়খন্ডের বিভিন্ন গ্রামে ফলের চারা সাইকেলে ফেরি করেন তাঁরা। চলতি বছর এদিনই প্রথম চারা নিয়ে ফরাক্কায় রওনা দিয়েছিলেন তাঁরা। লরির মাথায় ছিল প্রত্যেকের নিজের সাইকেল।
দুর্গাপুর গ্রামের বাসিন্দা নৈমুদ্দিন শেখ বলেন, “যাঁরা আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি, তাঁদের সকলেরই শিরদাঁড়া ও মাজা ভেঙে গিয়েছে। তাঁদের চিকিৎসা কি ভাবে হবে ভেবে পাচ্ছেন না পরিবারের লোকেরা।” নওদার আমতলার বাসিন্দ দুর্ঘটনাগ্রস্ত ছোট লরির মালিক তাহাজুদ্দিন মণ্ডল জানান, তিনি বহু কষ্টে ধার করে কিস্তিতে গাড়িটি কিনেছিলেন। বছর খানেকও হয়নি। নিজেই গাড়ি চালান। তাঁরই ছেলে গাড়িতে খালাসির কাজ করেন। তিনি বলেন, “ঠিক ছিল ওরা ফরাক্কায় থাকবে। আর কৃষ্ণনগর থেকে প্রতিদিন এক লরি করে ফলের চারা গাছ সেখানে পৌঁছে দেব আমি। কিন্তু তার আগেই এভাবে সব শেষ হয়ে যাবে স্বপ্নেও ভাবিনি।”
জেলার পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবীর বলেন, “৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক চার লেন হওয়ায় যানবাহনের গতিও বেড়েছে। এই অবস্থায় এ ভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তার পাশে শুয়ে থাকা উচিত হয়নি। সচেতনতার অভাবেই এই দুর্ঘটনা। যে লরিটির ধাক্কায় এই দুর্ঘটনা ঘটেছে সেটিও বেপরোয়া ভাবে চলছিল বলে জানা গিয়েছে। সেটিকে ধরা যায়নি।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy