Advertisement
১৯ মে ২০২৪

নিজের ‘নিয়ম’ ভেঙে এ বারের নির্বাচনে দিনভর রাস্তায় অধীর

“কী হয়েছে রে?” —“দেখো না দাদা, কানাই আমায় মেরেছে, বলছে আমি নাকি বহিরাগত।” —“তুই কী বললি?” —“আমি পড়ে গিয়েছিলাম। উঠে আমিও ধাক্কা মেরেছি।” কোমরে হাত দিয়ে কালো প্যান্ট, ঘিয়ে ফুল শার্ট বললেন, “বেশ করেছিস। ঢিল মারলে পাটকেলটা খেতে হয়।” ‘দাদা’র কাছে যিনি নালিশ করছিলেন পাঁচ মাস আগে (কংগ্রেসের) সেই হীরু হালদার হেরে গিয়েছেন কানাইয়ের (রায়) কাছে। আপাতত তিনি প্রাক্তন। সোমবার, ভোটের সকালে বহরমপুরের ছ’নম্বর ওয়ার্ডের মোহিনীপাড়া প্রথমবার যেন ভোটের চেনা গন্ধ ফিরে পেল।

তপ্ত ডাঙাপাড়ায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে মাঠে নামলেন অধীর। ছবি: গৌতম প্রামাণিক।

তপ্ত ডাঙাপাড়ায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে মাঠে নামলেন অধীর। ছবি: গৌতম প্রামাণিক।

রাহুল রায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৩ মে ২০১৪ ০১:১৯
Share: Save:

“কী হয়েছে রে?”

—“দেখো না দাদা, কানাই আমায় মেরেছে, বলছে আমি নাকি বহিরাগত।”

—“তুই কী বললি?”

—“আমি পড়ে গিয়েছিলাম। উঠে আমিও ধাক্কা মেরেছি।”

কোমরে হাত দিয়ে কালো প্যান্ট, ঘিয়ে ফুল শার্ট বললেন, “বেশ করেছিস। ঢিল মারলে পাটকেলটা খেতে হয়।” ‘দাদা’র কাছে যিনি নালিশ করছিলেন পাঁচ মাস আগে (কংগ্রেসের) সেই হীরু হালদার হেরে গিয়েছেন কানাইয়ের (রায়) কাছে। আপাতত তিনি প্রাক্তন।

সোমবার, ভোটের সকালে বহরমপুরের ছ’নম্বর ওয়ার্ডের মোহিনীপাড়া প্রথমবার যেন ভোটের চেনা গন্ধ ফিরে পেল। খানিক কথা কাটাকাটি, ঈষৎ তর্কাতর্কি, তারপর “এটা মুর্শিদাবাদ, ওরা যেন মনে রাখে”বলে দাদার নীল প্যাজোরা ফিরে গেল পার্টি অফিসে।

সকাল থেকেই এ নির্বাচনের গন্ধটা ছিল একটু অন্যতর। কাশিমবাজারের বাগানবাড়ি থেকে পাক্কা পৌনে দশটায় পার্টি অফিসে আসার পথেই তাঁর ব্ল্যাকবেরির স্ক্রিন ঘনঘন জ্বলে উঠেছে কখনও রেজিনগর, কান্দি, বড়ঞা কখনও বা শক্তিপুর থেকে উড়ে আসা দলীয় কর্মীদের ফোনে। ‘একবার ঘুরে যান দাদা, ভোট করতে দিচ্ছে না’কর্মীদের এমন আর্তি এ যাবৎ তাঁকে শুনতে হয়নি। রাজ্যে ক্ষমতাবদলের পরে গত পুর, পঞ্চায়েত নির্বাচনে এত ঝক্কি পোহাতে হয়নি তাঁকে। আর পাঁচ বছর আগে ২০০৯ এর লোকসভা ভোটে তো তিনি বাড়ির ‘কন্ট্রোল রুমে’ কাটিয়েছিলেন পাজামা-ফতুয়ার আমেজে।

এ বার যে তা হচ্ছে না কংগ্রেসের প্রদেশ সভাপতি তা আগেই আঁচ করেছিলেন। তাই এ দিন সকালে পার্টি অফিসে ঢুকেই ঘোষণা করেছিলেন, “এখনও তো কিছুই হয়নি। সারা দিনে অনেক বড় বড় ঘটনা ঘটবে। ওদের দিদি বুঝে গিয়েছে বাই হুক অর ক্রুক এ রাজ্য থেকে আসন না পেলে জাতীয় রাজনীতিতে তাঁর অস্তিত্বই থাকবে না। তাই মরিয়া হয়ে নোংরামি শুরু করেছে।”

সকালে জানিয়েছিলেন বটে, “আমি ভোটের দিন বেরোই না বিশেষ”। কিন্তু এ দিন কখনও বড়ঞা, কখনও হাটগাছি ছুটে, দিনভর চক্কর কেটে, কর্মীদের মনোবল চাঙ্গা করতে ৩৯ ডিগ্রি রোদ্দুর মাথায় নিয়ে ছুটে বেড়াতে হল তাঁকে। সেই দৌড়ে কখনও তর্ক করতে হল বিরোধী নেতাদের, কখনও বা প্রশাসনের কর্তাদের সঙ্গে।

তবে দাদা একবার ঘটনাস্থল পৌঁছে গেলে মুর্শিদাবাদ, তাঁর খাসতালুক যে এখনও হাতের মুঠো থেকে বেরিয়ে যায়নি তা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। সকালে ভোট দিতে গিয়েছিলেন শিল্পমন্দির গার্লস স্কুলে। ভোটের লাইনে দাঁড়াতেই অন্যেরা জায়গা ছেড়ে দিতে চাইলে হা হা করে উঠেছিলেন তিনি। “এ কি করছেন? আমি কী আলাদা কেউ?” এক বৃদ্ধা দূর থেকে তাঁকে আর্শীবাদ করে গেলেন। কখনও বা কলেজ বেলার নাট্যকর্মীকে দেখে হাত তুলে চেঁচিয়ে উঠলেন ‘শক্তিদা, ভাল আছেন?”

এই চেনা-অচেনার গন্ডী থেকে বেরোনো মাত্রই ফোন এল কংগ্রেসের মুর্শিদাবাদের জেলা সভাধিপতি শিলাদিত্য হালদারের।

— বুথটা একেবারে ‘বাপের রাজত্ব’ করে রেখেছে তৃণমূল।

— সেকি রে, বলেই বেরিয়ে পড়েছিলেন দাদা। হদ্দ গ্রাম হাটগাছিয়ায় গিয়ে দেখা গেল, দাদার প্রাক্তন দুই অনুগামী, নিয়ামত শেখ এবং সত্যেন চৌধুরী (যাঁরা এখন জেলা তৃণমূলের হর্তাকর্তা) সমানে তড়পে চলেছেন স্থানীয় পুলিশকর্মীদের। বুথের ধারেকাছে কংগ্রেস কর্মীরা বাঁশবাগানের ছায়ায় দাঁড়িয়ে তারস্বরে চেঁচাচ্ছেন, ‘দেখুন না দাদা, ভোটটা দিতেই দিচ্ছে না যে।’ আশপাশে কেন্দ্রীয় বাহিনী ছায়া খুঁজে ঝিমিয়ে আছে, হেলদোল বিশেষ নেই।

তিনি নামতেই ছবিটা অবশ্য পাল্টাল। পুলিশ সক্রিয় হল। বুথে ঢুকে কংগ্রেস এজেন্ট দাউদ শেখকে বুকে জড়িয়ে ধরে তিনি বললেন, “তুই তো বাঘের বাচ্চা রে। এই সন্ত্রাসের মধ্যেও বসে আছিস! জানি হারব, তবু তোদের দেখতেই আসা।”

বুথের সিঁড়িতে তৃণমূল প্রার্থী ইন্দ্রনীল সেন, হাতে নীল রঙের সিলিং ঝুলিয়ে বসে আছেন। বিরোধী প্রার্থীর দিকে তিনি কী একবার আড় চোখে তাকালেন? বোঝা গেল না। বোঝা গেল না গাছতলায় দাঁড়িয়ে থাকা কংগ্রেসের ওই সমর্থকেরাও হাটগাছিয়ার বুথে গিয়ে আর ভোট দিতে পারবেন কিনা? দাদার কনভয় অন্য ভাইদের আর্তিতে সাড়া দিয়ে এ বার ছুটল অন্যত্র।

ইন্দ্রনীল অবশ্য হাটগাছিয়ায় বসেই পাল্টা অভিযোগ করলেন, গুন্ডামিটা তো ওরাই করছে।

দুপুরে দেড়টা নাগাদ পার্টি অফিসের কন্ট্রোল রুমে ফিরেও তিনি জানিয়েছিলেন, আর বেরোতে হবে বলে মনে হচ্ছে না। ভাত, আম ডাল, লাউয়ের তরকারি আর বাটা মাছের ঝোল- লাঞ্চ সারার পরে গায়ের ঘামসিক্ত জামাটাও বদলে নিয়েছিলেন। তখনও কী জানতেন, নেপথ্যে ডাক দিচ্ছে বিন্দারপুর।

সে পথে ছুটতে ছুটতেই কান্দি বাসস্ট্যন্ডের কাছে থেমে গেল তাঁর গাড়ি। কাঁধে শব নিয়ে চলছে এক দঙ্গল যুবক।

—কী হল রে?

স্থানীয় কংগ্রেস নেতা দিলীপ চক্রবর্তী জানালেন, “আমার ভাই, কাল রাতে মোটরবাইক অ্যাক্সিডেন্টে...”

গাড়ি থেকে নেমে দাদা বলছেন, “দু’চাকার এই যানটা কত প্রাণ যে খেল!” ততক্ষণে বিন্দারপুর থেকে ঘনঘন ডাক আসতে শুরু করেছে। তুমুল ধুলো উড়িয়ে সেই হদ্দ গাঁয়ে গিয়ে দেখা গেল কংগ্রেসের ভোটারদের ভোট দেওয়া ‘নিষিদ্ধ’। সেখানেই আচমকা দেখা হয়ে গেল তাঁরই আরেক প্রতিদ্বন্দ্বী আরএসপির প্রমথেশ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। তাঁরও আর্তি, “দেখুন না, তৃণমূল ছাড়া কাওকেই ভোট দিতে দিচ্ছে না ওরা।”

—“ওরা টা কে?” অতঃপর প্রতিপক্ষকে পাশে নিয়েও গ্রাম ঘুরে খানিক অভয় দিলেন দাদা। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে ক্রিকেটও খেললেন বাচ্চাদের সঙ্গে। তারপর গ্রামের ঘরে ঘরে কড়া নেড়ে ভোটারদের জড়ো করে নিয়ে গেলেন বুথে।

দিনান্তে পার্টি অফিস প্রত্যাবর্তন।

—“এক গেলাস জল দে তো। আজ যা গেল না। নিজের নামটাই প্রায় ভুলে যাওয়ার জোগাড়।”

তিনি অধীররঞ্জন চৌধুরী। বহরমপুরের সাংসদ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

rahul roy lok sabha election adhir ranjan chowdhury
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE