একচিলতে ছাদে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে প্লাস্টিকের চেয়ার।
ভিড়টা আগে থেকেই জমছিল। সিঁড়ি বেয়ে বছর পঁয়তাল্লিশের চেনামুখ উঠে আসতেই শুরু হয়ে গেল হইহই।
ওরে পথ ছাড়, জামাই চলে এসেছে!
অ্যাই, চেয়ারে তুই কেন? জামাইকে বসতে দে!
জামাই মিনমিন করে শুধু বলার চেষ্টা করেছিলেন, “না, মানে আমার ভ্যানরিকশাটা...।” কথা শেষ না হতেই লোকজন হইহই করে ওঠেন, “রাখো তোমার ভ্যান! কেউ নিয়ে যাবে না। অনুষ্ঠানটা হয়ে যাক!”
বুধবার, জামাইষষ্ঠীর সকাল। নদিয়ার মুরুটিয়ায় পড়াতলা বাজার বাসস্ট্যান্ডে বিশ্রামাগারের ছাদে ততক্ষণে হাজির করিমপুরের বিধায়ক সমরেন্দ্রনাথ ঘোষ। বাজারে বেচা-কেনা ফেলে দোকানদারেরা ছাদে উঠে পড়েছেন। জড়ো হয়ে গিয়েছেন ব্যবসায়ী সমিতির মাথারা।
জামাই উত্তম সাহার আসল বাড়ি মুর্শিদাবাদের জলঙ্গির সাহেবরামপুরে। কিন্তু বিয়ের পর থেকে মুরুটিয়ায় শ্বশুরবাড়িতেই থাকেন তিনি। ভ্যানরিকশা চালান। স্ত্রী সান্ত্বনা লোকের বাড়িতে কাজ করেন। দুই ছেলেমেয়েও রয়েছে। এলাকার বেশির ভাগ লোক হয় তাঁর আসল নাম জানে না, বা জানলেও ভুলে মেরে দিয়েছে। বরং পড়াতলা তাঁকে ‘জামাই’ নামেই চেনে।
পাড়ার জামাই যে আর এক বিখ্যাত জামাই শিবঠাকুরকেও নেশায় হার মানায়, তা জানতেও অবিশ্যি পড়াতলার বেশি দিন লাগেনি। সারাক্ষণ দিশি মদে চুর। ভ্যানরিকশা চালায়, কিন্তু এতই নেশা করে থাকে যে লোকে তার গাড়িতে উঠতে ভয় পায়। প্রায়ই বাড়ি ফিরে বউ পেটায়। তাঁর রোজগারের টাকাও নেশা করে উড়িয়ে দেয়। রাতে হইচইয়ে পাড়ার লোকও অস্থির হয়ে পড়ে। কয়েক বার জামাইকে ধরে আড়ংধোলাইও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু নেশার ঘোরে তা-ও বিশেষ গায়ে লাগেনি জামাইয়ের।
শেষমেশ বাজারের লোকজনই ভেবেচিন্তে একটা উপায় বের করেন। মাস দুয়েক আগে কয়েক জন তাঁকে ধরে বোঝান, মদ ছাড়া কতটা জরুরি। সেই সঙ্গে প্রতিশ্রুতি “জামাই, চেষ্টাচরিত্র করে নেশাটা যদি ছাড়তে পারো, প্রাইজ পাবে!” খবর শুনে সান্ত্বনাও উসকে দেন “এত কিছু পারো আর এই ছাইভস্ম গেলা ছাড়তে পার না?” কথাগুলো মনে গিয়ে গেঁথেছিল উত্তমের। রাতে আর স্ত্রীর কথার কোনও উত্তর দেননি, পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন।
পরের দিন সকাল থেকেই জামাই অন্য মানুষ। একটাই ধনুকভাঙা পণ ‘নো দিশি!’ কিন্তু এত দিনের নেশা ছাড়া কি অত সহজ? গোড়ায় বেশ ক’দিন রাত্তিরে ঘুম হত না। আচমকা ঘুম ভেঙে সান্ত্বনা দেখতেন, অন্ধকারে উত্তম পায়চারি করছেন। দিনে শরীর ঝিমোত। ক’দিন পর থেকে অবশ্য ধীরে-ধীরে অবস্থাটা পাল্টে যায়। উল্টে অনেক বেশি সুস্থ-সতেজ বোধ করতে থাকেন উত্তম। চারপাশের লোকজনের ব্যবহারও পাল্টে যায়। স্থানীয় ব্যবসায়ী হিমাংশু সরকার, নিভাস প্রামাণিকেরা জানান, “আমরা নানা ভাবে পরীক্ষা করে দেখেছি, জামাই আর এক দিনও নেশা করেনি। নেশার খপ্পর থেকে ও সত্যিই বেরিয়ে এসেছে।”
পড়াতলা বাজারও কথা রেখেছে। নতুন জামা-কাপড়, মিষ্টির প্যাকেটে ষষ্ঠী করিয়েছে জামাইকে। শ্বশুর-শাশুড়ি বেঁচে নেই। উত্তমের তাই পুরোটাই উপরি পাওনা। সংবর্ধনা নিয়ে আপ্লুত গলায় তিনি বলেন, “বাইশ বছর আগে যে দিন বিয়ে করতে এই গ্রামে এসেছিলাম, সেই দিনটার কথা খুব মনে পড়ে যাচ্ছে। নেশা ছাড়লে যে এত ভালবাসা পাওয়া যায়, সত্যিই জানতাম না।” সান্ত্বনা বলছেন, “এখন আর সংসারে কোনও অশান্তি নেই। মা আজ বেঁচে থাকলে খুব খুশি হত।”
মায়ের বদলে তো মেয়েকেই তা হলে জামাইভোজ খাওয়াতে হবে! কী মেনু? “ভাত, আলু-পটলের তরকারি, মুরগি, দই-মিষ্টি” হাসছেন সান্ত্বনা।
ঘরে ফেরার পথে ভিড় থেকে ভেসে আসে “কী রে, পুরস্কারের আনন্দে সন্ধ্যায় দু’পাত্তর হয়ে যাক!” ভ্যানের প্যাডেলে পা রেখে উত্তম হেঁকে ওঠেন, “খামোশ!”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy