Advertisement
E-Paper

বৃদ্ধদের নিয়ে বিজয়া রেস্তোরাঁ কর্তৃপক্ষের

পরিবারের সঙ্গে রাত জেগে মণ্ডপ থেকে মণ্ডপ ঘুরে প্রতিমা দর্শন করে ভোরে বাড়ি ফেরা। পরের দিন সকালেই ঘুম থেকে উঠে ননদ-জায়েদের সঙ্গে নাড়ু-মুড়কি তৈরিতে বসে যাওয়া। নবমীর সকাল নারকেল নাড়ু-ঘি-নিমকি-ক্ষীরের মুড়কির গন্ধে ম-ম করত। বিজয়া দশমীর পরে শ্বশুর-শাশুড়ির পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে তাদের কাছ থেকে উপহার আদায়।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১৬ অক্টোবর ২০১৪ ০০:৫৪

পরিবারের সঙ্গে রাত জেগে মণ্ডপ থেকে মণ্ডপ ঘুরে প্রতিমা দর্শন করে ভোরে বাড়ি ফেরা। পরের দিন সকালেই ঘুম থেকে উঠে ননদ-জায়েদের সঙ্গে নাড়ু-মুড়কি তৈরিতে বসে যাওয়া। নবমীর সকাল নারকেল নাড়ু-ঘি-নিমকি-ক্ষীরের মুড়কির গন্ধে ম-ম করত। বিজয়া দশমীর পরে শ্বশুর-শাশুড়ির পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে তাদের কাছ থেকে উপহার আদায়।

বিজয়া সম্মিলনী উপলক্ষে বুধবার দুপুরে জড়ো হতেই ফেলে আসা সেই সব দিনের গল্প, হাসি-ঠাট্টায় মেতে উঠলেন বহরমপুরের ভাগীরথীর দু’পাড়ের দুটি বৃদ্ধাবাসের আবাসিকরা। যদিও ওই আবাসিকদের এক জায়গায় জড়ো করার পিছনে ছিল বহরমপুরের এক রেস্তোরাঁ কর্তৃপক্ষ। উদ্দেশ্য অবশ্যই বিজয়া সম্মিলনী। সেই সঙ্গে রেস্তোরাঁ’র জন্মোত্‌সব পালনও।

রেস্তোরাঁর মালিকদের অন্যতম নীলাঞ্জন পাল বলেন, “ওই বৃদ্ধ মানুষদের নিয়ে বিজয়া সম্মিলনী আয়োজনের মধ্যে দিয়েই আমাদের রেস্তোরাঁর জন্মদিন পালন করার সিদ্ধান্ত হয়।” সেই মতো এ দিন বহরমপুর প্রবীণ সভার কনফারেন্স হলে ওই দুটি বৃদ্ধাবাসের আবাসিকদের পাশাপাশি ডে-কেয়ার সেন্টারের আবাসিক মিলিয়ে প্রায় ৭৫ জনের খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করা হয়।

তার আগে প্রবীণসভা পরিচালিত ভাগীরথীর পশ্চিম পাড়ের ‘আনন্দনিকেতন’ বৃদ্ধাবাস থেকে কয়েক জন আবাসিককে নিয়ে আসা হয় প্রবীণসভার ধোপঘাটি’র বৃদ্ধাবাস ভবনে। ফলে সেই দিক থেকে দেখলে বিজয়া সম্মিলনী ও জন্মোত্‌সব পালনের সঙ্গে এ দিন দুই বৃদ্ধাবাসের আবাসিকদের মিলনোত্‌সবও হল। সত্তরোর্ধ্ব পাঞ্চালি ভট্টাচার্য বলেন, “সাড়ে পাঁচ বছর আগে স্বামী মারা যান। তার আগে আমার দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে যায়। কিন্তু বৃদ্ধ বয়সে মেয়েদের বোঝা হতে চাইনি। তাই বৃদ্ধাবাসে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়ে সাড়ে চার বছর আগে এখানে চলে আসি।”

কলকাতার বরানগরের বাসিন্দা পাঞ্চালিদেবী বলেন, “পুজোর চার দিন কলকাতার উত্তর-থেকে দক্ষিণ ঘুরে প্রতিমা দর্শন করে বেড়াতাম। তার মধ্যে নবমীর দিন সকালে জায়েদের সঙ্গে বসে যেতাম নাড়ু ও মুড়ির মোয়া, ক্ষীরের মোয়া, নিমকি, গজা বানাতে। কেননা, দশমীর পরেই আত্মীয়স্বজন থেকে পাড়া-প্রতিবেশি সকলেই প্রণাম করতে আসতেন বাড়িতে। ফলে তাঁদের মিষ্টিমুখ করার জন্য ওই সব বানানো হত।” তিনি জানান, “দশমীর পরে বাড়ির বড়দের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলে বাঙালদের মধ্যে পরবী দেওয়ার চল রয়েছে। সেই মত বিজয়ার পরে শ্বশুর-শাশুড়িকে প্রণাম করতাম। তাঁরা পরবী দিতেন। আমরাও আমাদের চেয়ে ছোটদের দিতাম।”

বৃদ্ধাবাসে আসার পরেও ওই নাড়ু-মুড়কি বানানোয় তিনি কোনও খামতি দেননি। আবাসিকরা নিজেদের মত করে চাঁদা তুলে প্রতি বছর নিয়ম করে নাড়ু-নিমকি-গজা বানান। এ বছর ছোট মেয়ের সঙ্গে দার্জিলিঙ বেড়াতে গিয়েছিলেন বলে ব্যতিক্রম হয়েছে। কিন্তু নাড়ু-মুড়কি না হলেও চাঁদা তোলা হয়েছে। ওই টাকায় পুজোর পরে টোস্টার কেনা হয়েছে। এই শীতে কাজে লাগবে।

অন্য এক আবাসিক বীরভূমের আমোদপুরে বাসিন্দা রঞ্জিতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “আমার দুই মেয়ে ও এক ছেলে। তিন জনেরই বিয়ে হয়ে গিয়েছে। বড় মেয়ে সিউড়িতে এবং ছোট মেয়ে ও ছেলে বোলপুরে থাকে। ছেলেমেয়ে সকলের নিজেদের সংসার রয়েছে। আমরা দুজন থাকলে তাদের সংসারের ছন্দপতন হতে পারেএই আশঙ্কায় বৃদ্ধাবাসে থাকার সিদ্ধান্ত নিই। তাতে ভালই আছি।”

তিনি জানান, “এখন বাড়ির বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের সঙ্গে কারও গল্প-গুজব করার সময় নেই। সকলেই ভীষণ ব্যস্ত। এখানে আমরা যারা আবাসিক রয়েছি, তারা একান্নবর্তী পরিবারের মত রয়েছি। সকলের সঙ্গে সুখ-দুঃখ-আনন্দ ভাগ করে নিয়ে গুল্প-গুজবে সমেয় কেটে যায়। তবু পুজোর দিনগুলো মনে পড়ে যায়। বিজয়া দশমীর আনন্দ। আত্মীয়স্বজন-পরিচিত-পাড়া-পড়শিরা আসত।”

সেই সব দিন অবশ্য কবেই হারিয়ে গিয়েছে। তবু শিউলির গন্ধ নাকে এলেই তাঁদের মনে পড়ে যায় নিকানো উঠোনের কথা, সেই উঠোনে ঝরে পড়া থাকা শিউলি, ভোরের দিকে জানালা বন্ধ করে গায়ে চাদর টেনে নেওয়া, রাত জেগে প্রতিমা দর্শন, বিজয়া দশমীর সন্ধ্যাগুলি পরিচিত-আত্মীয়স্বজন-পড়শিদের ভিড়ে ভরে থাকা দিনগুলির কথা।

তাই কর্তৃপক্ষ রেস্তোরাঁর জন্মদিন বৃদ্ধাবাসের আবাসিকদের নিয়ে বিজয়া সম্মিলনীর মাধ্যমে পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়ায় খুশি প্রবীণসভার কর্তারাও। প্রবীণসভার সদস্য মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আলি হাসান সমস্ত ব্যস্ততা ফেলে রেখে হাজির ছিলেন। প্রবীণসভার সদস্য অসিত বাগচি বলেন, “বৃদ্ধাবাসের ওই আবাসিকদের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য আমরা কৃতজ্ঞ ওই রেস্তোরাঁ কর্তৃপক্ষের উপরে।”

শুধু মাত্র দেশ-বিদেশের রসনার স্বাদের অভিজ্ঞতা এবং পারিবারিক সূত্র থেকে শেখা ‘বসুধৈবঃ কুটুম্বকম’ এবং ‘অতিথি দেবঃ ভবঃ’ সংস্কৃত ওই দুটি শব্দের উপরে ভরসা রেখে বহরমপুর রেজাউল করিম সরণী এলাকায় দশ বছর আগে ‘হেরিটেজ’ নামের ওই রেস্তোঁরা খোলেন চার জন খাদ্য রসিক মানুষ। উদ্দেশ্য ছিল আধুনিকতার সঙ্গে ঐহিত্যের সমন্বয় ঘটিয়ে নামী-দামি সংস্থার রন্ধন উপকরণ ব্যবহার করে নতুনত্বের স্বাদ পৌঁছে দেওয়া।

এ দিন দশম বর্ষ জন্মোত্‌সব তারই প্রমাণ। তবে জন্মদিনের সঙ্গে বিজয়া সম্মিলনী বিষয়টি নিয়ে রেস্তোরাঁ কর্তৃপক্ষ কী ভাবছে?

নীলাঞ্জনবাবু বলেন, “কোথাও সমাজে থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে রয়েছেন ওই বৃদ্ধ মানুষগুলো। বয়সের কারণে অশক্ত শরীর নিয়ে তাঁরা বিজয়ী দশমীর নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে কোথাও যেতে পারেন না। তাঁদের বিজয়া দশমীতে নিমন্ত্রণ করার মানুষের সংখ্যাও কমে গিয়েছে। ফলে তাঁদের জীবন থেকে এখন বিজয়া দশমী হারিয়েই গিয়েছে। আমাদের রেস্তোঁরার জন্মদিন পালনের আনন্দ ওই মানুষগুলির সঙ্গে ভাগ করে নিলাম। আমার তাঁদের কৃতজ্ঞ।”

বিজয়া সম্মিলনী উপলক্ষে এদিন দুপুরে যে বিশেষ খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করা হয়েছিল, সেই মেনু তালিকায় ছিলসরু চালের ভাত, মুগ ডাল, আলু ভাজা, ছানার ডালনা, মাছের কালিয়া, আমসত্ত্বের চাটনি, দই, রসগোল্লা। বয়সের কথা মাথায় রেখে তেল-মশলা বাহুল্য না রেখে ঘরোয়া রান্না খাওয়ানোয় খুশি আবাসিকরা। তাঁদের কথায় বার বার করে রান্নার স্বাদের কথায় উঠে এসেছে। আবাসিকদের কথায়, “অনেক দিন পরে এক সঙ্গে সকলে বসে খাওয়া-দাওয়া করতে পেরে ভীষণ ভাল লাগল। উত্‌সবের মেজাজও ছিল। খাওয়া-দাওয়ার পরে তুমুল গল্পগুজবেও মেতে ওঠেন তাঁরা।

সোয়া একটা থেকে তিনটে—ঘন্টা দুয়েক যেন তাঁদের জীবনের কয়েকটা দশক ফিরে পাওয়া!

bijaya restaurant berhampur aged
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy