Advertisement
E-Paper

হামলা করবে বলেই বোমা-গুলি নিয়ে এসেছিল ভাড়াটে গুন্ডারা

ভাড়াটে গুন্ডাদের দিয়ে গ্রামবাসীর উপর হামলা করে ২২ বিঘা জমির দখল নিতে চেয়েছিল জমি মাফিয়ারা। যে গুন্ডাদের গুলিতে প্রাণ হারান ঘুঘড়াগাছির বধূ অপর্ণা বাগ (৩৭), তাদের ভাড়া করা হয়েছিল কৃষ্ণগঞ্জ সংলগ্ন কোতোয়ালি থানার কিছু এলাকা ও চাপড়ার কিছু এলাকা থেকে। এই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত প্রধান যে দুই দুষ্কৃতীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ, সেই লঙ্কেশ্বর ঘোষ এবং পলাশ ঘোষকে জেরা করে এলাকার বেশ কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির নাম পেয়েছে পুলিশ।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২০ ডিসেম্বর ২০১৪ ০১:০৬
এই মাঠেই হামলা চালানো হয়েছিল। খুন হয়েছিলেন অপর্ণা বাগ।—ফাইল চিত্র।

এই মাঠেই হামলা চালানো হয়েছিল। খুন হয়েছিলেন অপর্ণা বাগ।—ফাইল চিত্র।

ভাড়াটে গুন্ডাদের দিয়ে গ্রামবাসীর উপর হামলা করে ২২ বিঘা জমির দখল নিতে চেয়েছিল জমি মাফিয়ারা। যে গুন্ডাদের গুলিতে প্রাণ হারান ঘুঘড়াগাছির বধূ অপর্ণা বাগ (৩৭), তাদের ভাড়া করা হয়েছিল কৃষ্ণগঞ্জ সংলগ্ন কোতোয়ালি থানার কিছু এলাকা ও চাপড়ার কিছু এলাকা থেকে। এই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত প্রধান যে দুই দুষ্কৃতীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ, সেই লঙ্কেশ্বর ঘোষ এবং পলাশ ঘোষকে জেরা করে এলাকার বেশ কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির নাম পেয়েছে পুলিশ।

প্রায় মাস খানেক তদন্তের পর পুলিশ মনে করছে, কৃষ্ণগঞ্জের ঘুঘড়াগাছিতে জমি দখলের চেষ্টায় দুষ্কৃতীদের বোমা-গুলির তাণ্ডব কেবল গোটাকতক স্থানীয় গুন্ডার কাজ নয়। রীতিমতো পরিকল্পনা করে এই কাজ করা হয়েছিল। লঙ্কেশ্বর ঘোষ ওরফে লঙ্কার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট পরীক্ষা করে পুলিশ দেখেছে, ঘটনার দিন কয়েক আগে সেখানে মোটা টাকা ঢুকেছিল। সেই টাকা ওই হামলার ঘটনার জন্য কি না, খতিয়ে দেখা হচ্ছে, জানান জেলা পুলিশের এক কর্তা।

তদন্ত এগোচ্ছে বলে পুলিশ দাবি করলেও, ঘুঘড়াগাছির বাসিন্দারা এখনও আতঙ্কে রয়েছেন। কারণ গত ২৩ নভেম্বরের সেই ভয়ানক ঘটনায় অভিযুক্ত ১২জনের মাত্র দু’জনকে ধরতে পেরেছে পুলিশ। দশজনই এখনও অধরা। সে দিনের সেই তাণ্ডবের প্রত্যক্ষদর্শী শিখা সর্দার, কালীদাসী বিশ্বাসরা এখনও ঠিকমতো ঘুমোতে পারেন না। পাশের স্বর্ণখালি বাজারে যেতেও ভয় পান তাঁরা। কেন? প্রশ্নটা করতেই ক্ষোভ উগরে দিলেন তাঁরা। “যারা জমি দখল করতে এসে বাড়ির মেয়েদের উপর গুলি চালায়, তারা কতটা হিংস্র বুঝতে পারছেন? দশজনই তো এখনও বাইরে। পুলিশে নালিশ করার বদলা নিতে ফের যে হামলা করবে না, তার ঠিক কী?”

কী হয়েছিল মাস খানেক আগে?

নিজের চাষ-করা জমির ফসলের উপর ট্র্যাক্টর চালিয়ে দিচ্ছে দুষ্কৃতীরা, শুনে আর বাড়িতে বসে থাকতে পারেননি ঘুঘড়াগাছির বধূ অপর্ণা বাগ। জমি বাঁচাতে, ফসল বাঁচাতে, খেতে ছুটেছিলেন। দুষ্কৃতীদের ছোঁড়া গুলি বুকে লেগে মাঠেই লুটিয়ে পড়েন অপর্ণা। সেখানেই প্রাণ হারান তিনি। গুলি লেগেছিল আরও দুই মহিলা, এবং এক ছাত্রের গায়ে।

সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হওয়ার পর ২৪ নভেম্বর পুলিশ ওই ঘটনার অন্যতম মূল অভিযুক্ত লঙ্কেশ্বর ঘোষ ওরফে লঙ্কাকে উত্তর ২৪ পরগনার গোপালনগর সীমান্ত থেকে গ্রেফতার করে। অন্যরা ততক্ষণে ফেরার। গত বুধবার চাপড়ার হুদোপাড়া সীমান্ত এলাকা থেকে পুলিশ পলাশ ঘোষ নামে আরও এক অভিযুক্তকে গ্রেফতার করে। বৃহস্পতিবার কৃষ্ণনগর সিজেএম আদালতে তোলা হলে বিচারক পলাশকে সাত দিনের পুলিশ হেফাজতের নির্দেশ দেন।

পুলিশের তদন্ত তেমন এগোয়নি, বলছেন সরকার পক্ষের আইনজীবী বীরেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ও। তিনি জানান, লঙ্কা গ্রেফতার হওয়ার পরে ১২ দিন পুলিশ হেফাজতে ছিল। এখন সে জেল হেফাজতে। তবে মামলা এখনও রয়েছে প্রাথমিক স্তরে। পুলিশ চার্জশিট জমা দিলে জজ কোর্টে মামলা শুরু হবে। বীরেশ্বরবাবু বলেন, “পুলিশের তদন্ত এখনও সে ভাবে গতি পায়নি।”

পুলিশসূত্রে খবর, জেরায় লঙ্কা বারবার দাবি করেছে যে, ওই জমি সে কিনতে চাইলেও খুনোখুনির ঘটনার সঙ্গে সে জড়িত নয়। এমনকী সে দিন সে ঘটনাস্থলেও ছিল না বলে তার দাবি। তবে জেলা পুলিশের এক কর্তা বলছেন, “লঙ্কা যা-ই দাবি করুক না কেন, সে-ই যে এই ঘটনার ‘মাস্টার মাইন্ড’ সে বিষয়ে আমরা প্রায় নিশ্চিত। সেই বিষয়ে বেশ কিছু তথ্যও আমাদের হাতে রয়েছে।” ওই পুলিশকর্তা বলেন, ওই এলাকার জমি কেনাবেচার যে সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে তার অন্যতম প্রধান এই লঙ্কা, সে ইঙ্গিত তাঁরা পেয়েছেন। ধৃত পলাশ ঘোষও জমি সিন্ডিকেটের আরও একজন পাণ্ডা। লঙ্কাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ সেদিনের হামলার সঙ্গে জড়িত বেশ কয়েকটি নতুন নাম জানতে পেরেছে, যে নামগুলি এফআইআর-এ নেই। পলাশকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ জানতে পেরেছে যে, পলাশ ২৩ নভেম্বর ঘটনাস্থলে ছিল। ভাড়াটে দুষ্কৃতী জোগাড় করা থেকে শুরু করে মাঠের ফসল নষ্ট করা ও মহিলাদের উপরে আক্রমণ সংগঠিত করার কাজে সে-ই নেতৃত্ব দিয়েছিল। দুষ্কৃতীদের আনা হয়েছিল কৃষ্ণগঞ্জ সংলগ্ন কোতোয়ালি থানার কিছু এলাকা ও চাপড়ার কিছু এলাকা থেকে।

পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, ঘুঘড়াগাছির ওই ২২ বিঘা জমি দখল করতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল লঙ্কা ও তার দলবল। কিন্তু বিশেষ সুবিধা করে উঠতে না পেরে রীতিমতো পরিকল্পনা করে লঙ্কা ও তার দলবল ঘুঘড়াগাছির মাঠে হামলা চালায়। জেলা পুলিশের ওই কর্তার কথায়, “শুধু ভয় দেখাতে নয়, হামলা করবে বলে লঙ্কার লোকজন তৈরি হয়েই এসেছিল।”

পুলিশ সুপার অর্ণব ঘোষ বলেন, “ধৃত লঙ্কাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে ও তার মোবাইলের কললিস্ট ঘেঁটে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছি। সেই তথ্যের ভিত্তিতেই আমরা এগোচ্ছি।” জেলা পুলিশের এক কর্তার কথায়, “সেই তথ্য যে নির্ভুল, তা আমরা পলাশকে গ্রেফতার করেই প্রমাণ করে দিয়েছি।” কী তথ্য পেয়েছে পুলিশ? জেলা পুলিশের এক কর্তার কথায়, “অভিযুক্তদের বাইরেও এমন কিছু নাম আমরা পেয়েছি যারা ওই ঘটনার সঙ্গে জড়িত। সেই তালিকায় রয়েছে এলাকার কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তিও। পরীক্ষা করা হয়েছে লঙ্কার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট। সেখানে ঘটনার দিন কয়েক আগে একটা মোটা অঙ্কের টাকা লঙ্কার অ্যাকাউন্টে ঢুকেছিল। সেই টাকা ওই দুষ্কৃতীদের পিছনে ঢালার কোনও পরিকল্পনা ছিল কি না তা-ও তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।”

ঘুঘড়াগাছি-কাণ্ডে সরাসরি তৃণমূল জড়িত বলে অভিযোগ তোলে বিরোধীরা। ঘটনার পরে ঘুঘড়াগাছিতে বিরোধীরা একের পর এক সভা করলেও তৃণমূল ওই গ্রামে ঢুকতে পারেনি। কৃষ্ণগঞ্জ ব্লক তৃণমূলের সভাপতি লক্ষ্মণ ঘোষচৌধুরীর প্রশ্রয়েই লঙ্কার উত্থান ঘটেছিল বলে অভিযোগ করেন গ্রামবাসীদের একাংশ ও বিরোধীরা। লঙ্কাও নিজেকে তৃণমূলের সক্রিয় কর্মী বলে জানিয়েছে। তৃণমূলের নেতারা তাঁকে চেনেন বলেও দাবি করেছে সে। তবে লক্ষ্মণবাবু বলেছিলেন, “লঙ্কাকে আমি চিনি। লঙ্কা তো গরু পাচারকারী, সমাজবিরোধী। তাঁকে দলের কাছাকাছি ঘেঁষতে দিইনি।”

‘প্রভাবশালী’ এই ব্যক্তিরা কারা? ঘুঘড়াগাছি তার উত্তর খুঁজছে। খুঁজছে গোটা রাজ্যও।

krishnaganj murder case ghugragachi aparna bag
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy