ইস্কোয় ১৮ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক উদ্ধোধন করে গিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ইস্পাত উৎপাদনের ক্ষেত্রে দেশকে স্বাবলম্বী হবার আহ্বানও জানিয়েছেন। কিন্তু শিল্পাঞ্চলে এসেও বন্ধ ও রুগ্ণ কারখানার ভবিষ্যত নিয়ে তিনি কথা না বলায় হতাশ শ্রমিক মহল থেকে শিল্পোদ্যোগীরা।
নব্বইয়ের দশক থেকে এখনও পর্যন্ত আসানসোল শিল্পাঞ্চলে অন্তত ছ’টি সরকারি ও বেসরকারি ভারী শিল্প বন্ধ হয়ে গিয়েছে। বন্ধের মুখে রূপনারায়ণপুরের হিন্দুস্তান কেবলস। পাঁচ বছর বন্ধ থাকার পরে ঠিকা প্রথায় খুললেও রুগ্ন দশা কাটিয়ে উঠতে পারেনি সেল বিকাশ সংস্থার কুলটি কারখানা। অনেকেই আশা করেছিলেন, ওই সমস্ত বন্ধ ও রুগ্ণ কারখানা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী কোনও ইতিবাচক বক্তব্য রাখবেন। কিন্তু তিনি কিছুই না বলায় সমালোচনায় মুখর হয়েছেন শ্রমিক সংগঠন থেকে শুরু করে কাজ হারানো কর্মীরা।
২০০১ সালে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল আসানসোলের রাষ্ট্রায়াত্ত সাইকেল কর্পোরেশন। প্রায় তিন হাজার শ্রমিক-কর্মী কাজ হারান। তাঁদের পাওনাগন্ডা মেটানো হলেও এলাকার অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়ে। ওই কারখানার প্রাক্তন কর্মী রথীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের আক্ষেপ, ‘‘দেখভাল না হওয়ায় কারখানার যন্ত্রাংশ, ছাউনি সব দুস্কৃতীরা চুরি করেছে। কয়েকশো একর জমি পড়ে আছে। আমরা আশা করেছিলাম, প্রধানমন্ত্রী শিল্পোন্নয়ন নিয়ে কিছু বলবেন। কিন্তু তিনি আমাদের হতাশ করলেন।’’
২০০২ সালে বন্ধ হয়েছিল জেকে নগরের রাষ্ট্রায়ত্ত অ্যালুমিনিয়াম কারখানা বালকো। কর্মহীন হন প্রায় ৪৮০ জন। শতাধিক কর্মীর পাওনা এখনও বাকি। সংস্থার প্রাক্তন কর্মী প্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের খেদ, ‘‘সরকার অনেক বার কারখানা খোলার কথা বলেও কিছু করেনি। এলাকার বেকার যুবকেরা চাকরি পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী এলাকার শিল্পের উন্নতি নিয়ে কিছুই বললেন না।’’
১৯৯৬ সালে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল রানিগঞ্জের রাষ্ট্রায়ত্ত বার্ন কোম্পানির ইট তৈরির কারখানা। কাজ যায় প্রায় এক হাজার শ্রমিক-কর্মীর। বকেয়া সংক্রান্ত একটি মামলা আদালতের বিচারাধীন থাকায় অনেকেরই পাওনা মেটানো হয়নি। সংস্থার প্রাক্তন শ্রমিক তপন মণ্ডল বলেন, ‘‘কারখানার জমি তো পড়েই আছে। সেখানে শিল্প হলে বেকার যুবকেরা কাজ পেতেন। কিন্তু শিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী কিছু না বলায় হতাশ হয়েছি।’’
২০১১ সালে বন্ধ হয়ে গিয়েছে রানিগঞ্জের বেসরকারি জুট কারখানা, আসানসোলের ধাদকা অঞ্চলের নীল কারখানা। কর্মহীন হয়েছেন আরও প্রায় হাজার তিনেক। ২০০৩ সালে বন্ধ হয়েছে ইস্কোর কুলটি কারখানা। ২০০৮ সালে সেল বিকাশ সংস্থার অধীনে কারখানাটি ফের খোলা হয়। কিন্তু স্থায়ী নিয়োগ হয়নি। ঠিকা প্রথায় কাজ চললেও রুগ্ণ দশা কাটেনি। সদ্য শেষ হওয়া অর্থবর্ষেও লাভের মুখ দেখেনি সংস্থাটি। কর্তৃপক্ষের আশঙ্কা, বিনিয়োগ না হলে ফের বন্ধ করে দিতে হবে কারখানা।
সরকারি ভাবে পুরোপুরি বন্ধের ঘোষণা এখনও করা না হলেও পুনরুজ্জীবনের আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছেন রুপনারায়ণপুরের হিন্দুস্তান কেবলস কারখানার কর্মীরা। ১৯৫২ সালে জন্ম টেলিফোন কেবল তৈরির কারখানার, রুগ্ণ ঘোষিত হয় ২০০৩ সালে। বিআইএফআর-এ পাঠানো হয়। বহু চেষ্টা সত্ত্বেও তা আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। উৎপাদনশূন্য কারখানায় প্রায় ৮০০ শ্রমিক-কর্মী আছেন। ১৪ মাসের বেতন বাকি থাকায় কার্যত অর্ধাহারে দিন গুজরান হচ্ছে তাঁদের। সংস্থার কর্মী মেঘনাদ বন্দ্যোপাধ্যায় বা উমেশ ঝায়েরা বলেন, ‘‘ভেবেছিলাম, প্রধানমন্ত্রী কারখানার পুনরুজ্জীবন নিয়ে কিছু বলবেন। শ্রমিক-কর্মীদের পাশে দাঁড়াবেন। কিন্তু তিনি তো এই নিয়ে একটিও শব্দ উচ্চারণ করলেন না!’’
একই কারণে ক্ষুব্ধ শ্রমিক সংগঠনগুলিও। বিএমএসের জাতীয় কর্মসমিতির নেতা রামইলিশ রায় বলেন, ‘‘আমরা প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে দূঃখ পেয়েছি। এলাকার কর্মসংস্থান কী ভাবে বাড়বে সেই দিশা দেখাতে পারলেন না তিনি। রুগ্ণ শিল্পের ভবিষ্যত নিয়ে কিছুই বললেন না।’’ আসানসোলের প্রাক্তন সাংসদ তথা সিটুর জেলা সম্পাদক বংশগোপাল চৌধুরী বলেন, ‘‘সত্যি বলতে, আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে কিছু আশা করিনি। তবু তাঁর সফরের অপেক্ষায় ছিলাম। কিছুই হল না। বন্ধ ও রুগ্ণ সংস্থার অবস্থা ফেরাতে আমরা লাগাতার আন্দোলনে নামছি।’’
আইএনটিইউসি-র বর্ধমান জেলা সম্পাদক চণ্ডী চট্টোপাধ্যায়ের মতে, ‘‘প্রধানমন্ত্রী গোটা শিল্পাঞ্চলকে হতাশ করেছেন। এখানকার বন্ধ ও রুগ্ণ সংস্থার শ্রমিক-কর্মীদের স্বার্থে আমরা ইতিমধ্যে আন্দোলন শুরু করেছি।’’ আইএনটিটিইউসি-র জেলা সভাপতি প্রভাত চট্টোপাধ্যায়ও একই সুরে বলেন, ‘‘আমরা আশা করেছিলাম, শিল্পের উন্নয়নে তিনি ইতিবাচক কিছু বলবেন। কিন্তু আমরা হতাশ। বন্ধ ও রুগ্ণ সংস্থা না বাঁচলে শিল্পাঞ্চলের উন্নতি হবে না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy