Advertisement
E-Paper

গ্রামীণ শিল্পে নয়া তালিমের জিয়নকাঠি

সল্টলেকের মাঠের চিলতে কোণে বারাক হুসেন ওবামা-র ছায়া। ৮২ বছরের স্নিগ্ধ দিদিমা হেসে বলছেন, ‘‘আমি তো ইংরেজি জানি না, হিন্দিও জানি না! তবে কাঁথাখান দেখে ল-ম্বা লোকটা আমায় জড়ায়ে ধরেছিল।’’

ঋজু বসু

শেষ আপডেট: ০৪ ডিসেম্বর ২০১৫ ০৩:৪৪
নকশিকাঁথার পাঠ। কাজ শেখাচ্ছেন সবিহার বানু (ডান দিকে)। কারিগর হাটে। ছবি: রণজিৎ নন্দী।

নকশিকাঁথার পাঠ। কাজ শেখাচ্ছেন সবিহার বানু (ডান দিকে)। কারিগর হাটে। ছবি: রণজিৎ নন্দী।

সল্টলেকের মাঠের চিলতে কোণে বারাক হুসেন ওবামা-র ছায়া। ৮২ বছরের স্নিগ্ধ দিদিমা হেসে বলছেন, ‘‘আমি তো ইংরেজি জানি না, হিন্দিও জানি না! তবে কাঁথাখান দেখে ল-ম্বা লোকটা আমায় জড়ায়ে ধরেছিল।’’

আট বছর আগের ঘটনা। দিল্লির প্রগতি ময়দানে ক্র্যাফ্‌টস মিউজিয়মে নানুরের পাটনীল গাঁয়ের সবিহার বানুর হাতে বোনা নকশিকাঁথায় মুগ্ধ হয়েছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। কিনে নেন তখনই। সবিহারের ডান চোখে ইতিমধ্যে ছানি কাটা হয়েছে। চোখে চশমা। কিন্তু ফ্রেম হাতে কাঁথার গায়ে মনের ছবি ফুটিয়ে তোলায় ছেদ পড়েনি। নিজে তো সচল আছেনই। মেয়ে, বউমা, নাতনি— সবাইকে নিয়ে পরম আদরে বাঁচিয়ে রেখেছেন ক্রমশ ভুলতে বসা বাংলার কাঁথাকাজের পরম্পরা।

গুজরাতের কচ্ছের ২২ বছরের তরুণের স্মৃতি আরও টাটকা। গত বছর অক্টোবরের ঘটনা। তাঁদের পারিবারিক শিল্পকলা প্রাচীন ইরানি ঘরানার দুর্লভ রোগান চিত্রকলার স্মারক ওবামার হাতে তুলে দিয়েছিলেন স্বয়ং দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ২২ বছরের জব্বর খাতরি বলছিলেন, তাঁর দাদা আব্দুলগফুর খাতরি দিল্লিতে গিয়ে ‘মোদীজি’-র হাতে ছবির দু’টো ফ্রেম তুলে দেন।

সল্টলেকের সেন্ট্রাল পার্কের মাঠে রকমারি শিল্পঘরানার মেলায় পাশাপাশি দু’টো স্টলে কচ্ছের রোগান চিত্রকলা ও বীরভূমের কাঁথাশিল্পের সহাবস্থান। একুশ শতকের ক্যানভাসে এ সব প্রাচীন ঘরানার টিকে থাকার রাস্তা বাতলে দিতে এগিয়ে এসেছে নাবার্ড। এইম (আর্ট ইলিউমিনেট্‌স ম্যানকাইন্ড)-বলে একটি সংস্থার আয়োজনে মেলার মাঠেই লোকশিল্পীদের কাজ যুগোপযোগী করার তালিম দিচ্ছে তারা। নাবার্ড-এর পশ্চিমবঙ্গ শাখার চিফ জেনারেল ম্যানেজার রাজি গায়েনের মতে, ‘‘গ্রামীণ জীবনযাত্রার মান উন্নত করার স্বার্থেই এই তালিম দরকার।’’

জব্বর খাতরির ‘বড়ে পাপা’ গফুরভাই খাতরি এই সার কথাটা বুঝেছিলেন আশির দশকের শেষ দিকে। তখন থেকেই রোগান চিত্রকলা কী ভাবে আরও সূক্ষ্ম কারুকাজে পাল্টে ফেলা যায়, তা নিয়ে ভাবনা-চিন্তার শুরু। ‘রোগান’ মানে তেল। ক্যাস্টর অয়েল ফুটিয়ে ঠান্ডা জলে মিশিয়ে তৈরি এক ধরনের থকথকে মণ্ডে নানা ধরনের রং মিশিয়ে এই শিল্পঘরানার জন্ম। সময়ের সঙ্গে কুর্তা-দোপাট্টার আঙ্গিকেও এই চিত্রশৈলী প্রতিষ্ঠা করেছে খাতরি পরিবার। ভুজ থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে খাতরিদের গ্রাম নিরোনা। ভূমিকম্পের ধাক্কায় টালমাটাল হয়েও হার মানেননি ওঁরা। বরং ওই তল্লাটের কয়েকশো মেয়েকে তালিম দিয়েছেন।

সবিহার বানুর রক্তেও তাঁর মা-নানির ঘরানা। শুধু যে ওবামা ৮৫ হাজার টাকা দিয়ে তাঁর হাতের কাঁথা কিনেছেন তাই নয়, কাঁথার কাজের কসরতেই জীবনভর অর্ধেক দুনিয়া ঘুরেছেন তিনি। বিয়ের সময়ে নানির মমতা-মাখা দেড়শো বছরের পুরনো সুজনি কাঁথাখানা ট্রাঙ্কবন্দি করে এনেছেন কলকাতাতেও। মেয়ে মমতাজ, কিশোরী নাতনি মাসুদা সুলতানাদের নিয়ে সে-কাঁথা খুলে দেখাতে দেখাতে সবিহার বলেন, ‘‘তখনকার সুতো হতো শাড়ির পাড় দিয়ে। আর ফুল-পাত্তির এই নকশা হল বাংলার কাঁথার আদি নকশা।’’ নানুরে কয়েকশো মেয়েকে কাঁথাশিল্পে তালিম দেন সবিহার। কয়েক বছর আগে গোটা রামায়ণের উপরে কাজ শেষ করেছেন। ৫২টি ছবিতে রামের জন্ম থেকে সীতার পাতাল-প্রবেশের কাহিনি। কলকাতার একটি পাঁচতারা হোটেলে সে-কাঁথা এখন ঠাঁই পেয়েছে।

জব্বর বা সবিহান বানুরা এ ভাবেই অখ্যাত শিল্পীদের পথ চলার প্রেরণা হয়ে উঠেছেন।

method training village artisans riju basu salt-lake craft fair
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy