Advertisement
E-Paper

সবুজ বিপদ! ‘তাজা’ সব্জি খেয়েই রক্তে ঢুকছে বিষ

বন্ধু সেজে বিপদ সবার দাঁড়িয়ে আছে এ কী! এ এক অন্য ছদ্মবেশীর সার-সত্য। রক্তাল্পতা-সহ একাধিক রোগে ভুগছিলেন টালিগঞ্জের এক গৃহবধূ। মাঝবয়সি ওই মহিলাকে পারিবারিক চিকিৎসক পরামর্শ দেন প্রচুর তাজা শাক-সব্জি খাওয়ার। দিনের পর দিন তা-ই খেয়ে গিয়েছেন মহিলা।

সুপ্রকাশ মণ্ডল

শেষ আপডেট: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০৩:৫৬

বন্ধু সেজে বিপদ সবার দাঁড়িয়ে আছে এ কী!

এ এক অন্য ছদ্মবেশীর সার-সত্য। রক্তাল্পতা-সহ একাধিক রোগে ভুগছিলেন টালিগঞ্জের এক গৃহবধূ। মাঝবয়সি ওই মহিলাকে পারিবারিক চিকিৎসক পরামর্শ দেন প্রচুর তাজা শাক-সব্জি খাওয়ার। দিনের পর দিন তা-ই খেয়ে গিয়েছেন মহিলা। লাভ তো হয়ইনি, বরং রোগ আরও জটিল হয়ে ওঠে। যোগ হয় বাড়তি কিছু উপসর্গও। পরীক্ষায় ধরা পড়ে, হিমোগ্লোবিনে অতিরিক্ত নাইট্রাইট মিশে গিয়ে বিষিয়ে তুলছে রক্ত। সেই রক্ত গোটা শরীরে অক্সিজেন পৌঁছে দেওয়ার কাজও করে উঠতে পারছে না ঠিক মতো।

শরীরে এত নাইট্রাইট এল কোথা থেকে? অনেক পরীক্ষার পর জানা গেল, শাক-সব্জি থেকেই শরীরে সেঁধিয়েছে ক্ষতিকর নাইট্রাইট। উপকারী শাক-সব্জিই যদি বিষের ছদ্মবেশী বাহক হয়ে এ ভাবে বিষিয়ে দেয় শরীর, মানুষ তবে খাবে কী? সব্জিতেই বা এত নাইট্রাইট আসছে কেমন করে? এ কি বরাবরই ছিল?

কৃষিবিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, এটা মাত্রাতিরিক্ত ইউরিয়া অর্থাৎ নাইট্রোজেন সার প্রয়োগের ফল। এত দিন বেশি আলোচনা হতো কীটনাশকের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে। কিন্তু ইউরিয়ার মতো রাসায়নিক সারও যে মারাত্মক ক্ষতি করছে, সেটা বুঝেই গত বছর কেন্দ্রীয় সরকার ‘সাধারণ ইউরিয়া’র বিক্রিই বন্ধ করে দিয়েছে। তার বদলে ব্যবহার করা হচ্ছে ‘নিম কোটেড’ ইউরিয়া। কিন্তু তাতেও বিপদ কতটা কমছে, সেটাই ভাবাচ্ছে কৃষিবিজ্ঞানীদের।

রাসায়নিক সার দেওয়ার কুফল নিয়ে চর্চা অবশ্য আজকের নয়। যে কারণে বিনা সারে অর্থাৎ জৈব চাষে জোর দিচ্ছেন অনেকে। কিন্তু কৃষিবিজ্ঞানীরা মানছেন, এই পথে দেশের সওয়াশো কোটি মানুষের চাহিদা মেটানো অসম্ভব। ফলে মাটিকে উর্বর করতে ও গাছের খাবার হিসেবে জমিতে নাইট্রোজেন সারের অনিয়ন্ত্রিত প্রয়োগ চলছে গত শতকের ছয়ের দশক, অর্থাৎ সেই সবুজ বিপ্লবের সময় থেকেই। সেই সাফল্যই তলে তলে মহাবিপদ হয়ে উঠেছে এখন।

বিপদটা ঠিক কেমন?

কৃষিবিজ্ঞানীরা বলছেন, ‘‘অতিরিক্ত ইউরিয়ার ব্যবহার শরীরের ক্ষতি তো করছেই, বিষিয়ে দিচ্ছে পরিবেশও।’’ বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি রসায়ন এবং মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের গবেষক বিশ্বপতি মণ্ডল জানাচ্ছেন, নাইট্রোজেন সার তিন ভাবে ক্ষতি করছে। এক, শাক-সব্জির মাধ্যমে নাইট্রেট ঢুকছে শরীরে। দুই, ভূগর্ভস্থ জলে নাইট্রেট মিশে আর এক বিপদ ডেকে আনছে। তিন, এই বাড়তি নাইট্রোজেনই আবার বিশ্ব উষ্ণায়নের জন্য প্রবল ভাবে দায়ী।

বিশ্বপতিবাবু জানাচ্ছেন, সারের নাইট্রোজেনের ৩০% গাছ নিতে পারে। শাক-সব্জি-ফলের মাধ্যমে তা নাইট্রেট আকারে শরীরে ঢুকছে। পরে যা নাইট্রাইটে পরিণত হচ্ছে। বাকি ৭০%-এর একটা বড় অংশ নাইট্রেট রূপে ভূগর্ভস্থ জলে গিয়ে মিশছে। মাটির নীচ থেকে তোলা পানীয় জলের সঙ্গে সেই নাইট্রেটও আমাদের শরীরে প্রবেশে করছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা হু-র রিপোর্ট অনুযায়ী পানীয় জলে নাইট্রেটের সহনশীলতার মাত্রা প্রতি লিটারে ৫০ মিলিগ্রাম। ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলির পানীয় জলে এর পরিমাণ অনেক বেশি।

মাটিতে জমে থাকা নাইট্রোজেনের আর একটি অংশ নাইট্রাস অক্সাইডে পরিণত হয়। হায়দরাবাদে সেন্ট্রাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট ফর ড্রাইল্যান্ড এগ্রিকালচার (ক্রিডা)-এ আবহাওয়ার পরিবর্তন নিয়ে গবেষণা করছেন কৃষিবিজ্ঞানী শ্রীনিবাস রাও। তাঁর বক্তব্য, ‘‘নাইট্রাস অক্সাইড পরিবেশের পক্ষে মারাত্মক ক্ষতিকর। এটা কার্বন ডাই অক্সাইডের তুলনায় পরিবেশকে তিন গুণ বেশি উত্তপ্ত করে। বিশ্ব উষ্ণায়নের জন্য তাই নাইট্রোজেন সার থেকে তৈরি এই নাইট্রাস অক্সাইড প্রবল ভাবে দায়ী।’’

দেখা যাক, নাইট্রেট বা তা থেকে তৈরি হওয়া নাইট্রাইট শরীরের পক্ষে কতটা ক্ষতিকর? বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা হু-র রিপোর্ট বলছে, শরীরে নিয়মিত নাইট্রেট গেলে শিশুদের মিথমোগ্লোবিনামিয়া রোগ হতে পারে। এই রোগ ব্লু বেবি সিনড্রোম নামেও পরিচিত। এতে আক্রান্ত হয়ে আফ্রিকার দেশগুলিতে প্রচুর শিশু মারা যায়। ভারত, বাংলাদেশ বা পাকিস্তানের মতো দেশে গ্রামাঞ্চলেও এই রোগের দেখা মিলছে।

এটা কি ক্যানসারেরও কারণ?

টাটা কেমিক্যালস-এর পুণে ইনস্টিউটে রাসায়নিক সার নিয়ে গবেষণা করছেন বিজ্ঞানী শুভেন্দু ভদ্র রায়। তিনি বলেন, ‘‘নাইট্রেটের প্রভাবে ক্যানসার হতে পারে, বিজ্ঞানীদের একটি অংশের মত এমনই। তবে এ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। প্রচুর গবেষণাও চলছে এই বিষয়ে।’’

আর বিশ্বপতিবাবু বলছেন, ‘‘শরীরে নিয়মিত নাইট্রাইট ঢুকলে যে ক্যানসার হবে, এমন কথা আমি এখনই বলতে পারছি না। কিন্তু, ক্যানসার হবে না বলেই যে এটা কম ক্ষতিকর, তা-ও তো বলা যাচ্ছে না।’’

কিন্তু প্রশ্ন হল, সরকার নিজেই যেখানে ইউরিয়া সারে প্রচুর পরিমাণে ভর্তুকি দেয়, সেখানে এই সমস্যা থেকে মুক্তির উপায় কী? শুভেন্দুবাবু মনে করেন, সরকার ভর্তুকি দেয় বলে চাষিরাও মনে করেন, ইউরিয়া ব্যবহার করলে ফসল ভাল হবে। এটা ভুল ধারণা। রাস্তার ধারে প্রচুর আগাছা হয়। সার ছাড়া সেগুলি বড় হয়, ফুল-ফলও হয়। তবে এটা ঘটনা, গাছের যে যে খাদ্যগুণ প্রয়োজন, সব মাটিতে তা উপযুক্ত পরিমাণে থাকে না। সে জন্য সার দিতেই হয়।

তবে কী ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে ইউরিয়ার ব্যবহার?

কৃষিবিজ্ঞানীদের পরামর্শ:

• প্রথমেই ঢালাও সার না দিয়ে আগে মাটি পরীক্ষা করাতে হবে। তার পর প্রয়োজন অনুসারে সার প্রয়োগ করতে হবে। • মাটি পরীক্ষা করা সম্ভব না হলে, প্রথমে কোনও সারই দেওয়ার দরকারই নেই। পরে গাছের লক্ষণ দেখে প্রয়োজনীয় সার প্রয়োগ করতে হবে। তা হলেই ফল মিলবে। • মাটিতে না দিয়ে জলে গোলা সার পাতায় স্প্রে করা ভাল। l আরও উন্নত আবৃত (কোটেড) ইউরিয়া ব্যবহার করা। আবরণ ভেদ করে এগুলির নাইট্রেজেন মাটির জলে ধীরে মেশে বলে কম ক্ষতিকারক। কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে বাজারে এখন সাধারণ ইউরিয়ার বদলে বিক্রি হচ্ছে ‘নিম কোটেড’ ইউরিয়া। কিন্তু কৃষিবিজ্ঞানীরা বলছেন, আরও ভাল হয় যদি ‘পলিমার কোটেড'’ বা ‘সালফার কোটেড’ ইউরিয়া বিক্রির ব্যবস্থা করা হয়। • সেই সঙ্গে শুভেন্দুবাবুদের পরামর্শ, জিপিএস প্রযুক্তি ব্যবহার করে এক-একটি ব্লক বা বড় এলাকা ধরে ধরে মাটি পরীক্ষা করা হোক। তার ভিত্তিতে যেখানে যে সার প্রয়োজন, তার বাইরে অন্য সার বিক্রি নিয়ন্ত্রণ করা হোক।

বিশ্ব জুড়ে নাইট্রোজেন সারের অতিরিক্ত ব্যবহারে রক্ত বিষিয়ে যাওয়া ও উষ্ণায়নের বিপদ নিয়ে রীতিমতো উদ্বিগ্ন ‘হু’। বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যলয়ের বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি এ নিয়ে এক আলোচনাসভার আয়োজন করেছিলেন। দেশের প্রায় দেড়শো কৃষিবিজ্ঞানী এবং সার প্রস্তুতকারী সংস্থার গবেষকরা তাতে যোগ দেন। তাঁদের পরামর্শ, আপদ হয়ে ওঠা বন্ধুটিকে এখনই বিদেয় করা যাচ্ছে না। তবে ইউরিয়ার সীমিত, সতর্ক ও সজাগ ব্যবহার ভীষণ জরুরি।

Blood Nitrite Doctors Vegetables
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy