গড়কিল্লা গ্রামের বাড়ি থেকে মঙ্গলবার পুলিশ আটক করে রামপদর বাবা-মাকে। — পার্থপ্রতিম দাস।
কোনও কাজেই মন ছিল না তার। মুদি দোকান, সেলুন— টেঁকেনি কোনও ব্যবসাই। একাধিক লোকের কাছ থেকে টাকা ধার করায় বাড়িতেও পাওনাদারদের আনাগোনা লেগেই থাকত। বাড়ির ছেলেকে বাগে আনতে না পেরে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিলেন পরিজনেরাও। বছর পাঁচেক আগে কার্যত বাধ্য হয়েই বড়ছেলেকে বাড়ি থেকে বের করে দেন বাবা-মা। সেই ছেলেই এত বড় কাণ্ড ঘটাতে পারে, বিশ্বাস করতে পারছেন না কেউ।
গত শনিবার তমলুকের গড়কিল্লা গ্রামে পানের বরজ থেকে বছর চব্বিশের এক তরুণীর মুণ্ডহীন দেহ উদ্ধার হয়। ঘটনায় নাম জড়ায় গ্রামেরই যুবক রামপদ মান্নার। মঙ্গলবার বাগুইআটি থেকে তাঁকে গ্রেফতার করে পুলিশ। আটক করা হয়েছে রামপদর বাবা চণ্ডীচরণ মান্না ও মা সাবিত্রীকে। রামপদর শ্বশুর নিমাই ও শাশুড়ি পুষ্পরানিকেও আটক করেছে পুলিশ।
অষ্টম শ্রেণিতেই পড়াশোনা ছেড়ে দেয় রামপদ। একই পাড়ার বাসিন্দা এক তরুণীকে ভালবেসে বিয়ে করে সে। রামপদর বাবা চণ্ডীচরণবাবু গড়কিল্লা গ্রামের প্রাক্তন কংগ্রেস পঞ্চায়েত সদস্য। চার ভাইয়ের মধ্যে রামপদই বড়। ছেলের মতি ফেরাতে পরিবারের লোকেরা গ্রামেই মুদি দোকান গড়ে দেয়। যদিও সেই ব্যবসা চলেনি। পরে তমলুকের শঙ্করআড়ায় সেলুনও বানিয়ে দেওয়া হয়। সেই দোকানও চালাতে পারেনি রামপদ।
স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রথম থেকেই টাকাপয়সার প্রতি প্রবল ঝোঁক ছিল তার। রোজগারের চেয়ে খরচ বেশি হওয়ায় নানা অজুহাতে এলাকার বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে রামপদ টাকা ধার নিত বলে অভিযোগ। প্রায়ই ধারের টাকা ফেরত চেয়ে বাড়িতে তাগাদা দিতেন পাওনাদারেরা। টাকাপয়সা ধার নিয়ে শোধ না করার জন্য তাকে গ্রামের অনেকে অপছন্দ করত। এ নিয়ে পরিবারেও অশান্তি লেগেই ছিল। বছর পাঁচেক আগে স্ত্রী ও তিন মেয়েকে নিয়ে গড়কিল্লা গ্রামের বাড়ি থেকে কলকাতার বাগুইআটি চলে যায় রামপদ। সেখানেও সেলুন খোলে সে। পুলিশ জেনেছে, কলকাতায় তপন মান্না নাম নিয়ে থাকত সে। প্রয়োজন ছাড়া বাড়িতে সে বিশেষ আসত না। পরিজনেদের সঙ্গেও তার ভাল সম্পর্ক ছিল না।
লক্ষ্মীপুজোর দিন গ্রামে মুণ্ডহীন তরুণীর দেহ উদ্ধারের ঘটনাতেই গ্রামে আলোড়ন পড়েছিল। ওই ঘটনায় গ্রামেরই যুবকের নাম জড়ানোয় অবাক সকলেই। তন্ত্রসাধনার অজুহাতে এক তরুণীকে নৃশংসভাবে খুনের ঘটনা প্রকাশ্যে আসায় এলাকার বাসিন্দারা তার কঠোর শাস্তির দাবি তুলেছেন। স্থানীয় বাসিন্দা স্বপন পাত্র, দিপালী আদক এ দিন বলেন, ‘‘এলাকায় রামপদর সুনাম ছিল না। টাকাপয়সা ধার নেওয়ার পর সে শোধ করত না। কিন্তু এ ভাবে গ্রামের মধ্যে নিয়ে এসে ও কাউকে খুন করবে ভাবতে পারছি না।’’
এ দিন উত্তর উসুদপুর গ্রামে ওই তরুণীর কাটা মুণ্ড উদ্ধারের পর রামপদকে থানায় নিয়ে আসার সময় স্থানীয়রা তার ফাঁসির দাবি জানায়। এলাকার বাসিন্দা দিলীপ বর্মন, দুর্গাবালা মহিষ, নন্দলাল বাড় বলেন, ‘‘বাইরে থেকে মহিলাকে প্রলোভন দেখিয়ে গ্রামে নিয়ে এসে এমন নৃশংস খুনের ঘটনায় আমরা আতঙ্কিত। আমরা চাই এই ঘটনায় রামপদ ছাড়া আরও যারা জড়িত সকলের কঠোর শাস্তি হোক।’’ একইভাবে স্থানীয় নীলকুন্ঠা গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান সঞ্জয় ভঞ্জও বলেন, ‘‘এই ঘটনার জেরে এলাকার মানুষ নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। আমরা চাই ঘটনায় যারাই জড়িত থাকুক তাদের উপযুক্ত শাস্তি হোক।’’
ছেলের এমন কাণ্ডে ক্ষুব্ধ মা সাবিত্রীও। তাঁর অভিযোগ, ‘‘রামপদর প্রথম থেকেই টাকার প্রতি লোভ ছিল। লোকের কাছে টাকা ধার নিয়ে শোধ করত না। সে জন্য আমাদেরও নানা কথা শুনতে হত। ওর ধার করা প্রায় ২ লক্ষ টাকা আমাদের শোধ করতে হয়েছিল। কিন্তু ও গ্রামে এসে কখন এই ঘটনা ঘটিয়েছে জানতাম না।’’ পুলিশের দাবি, রামপদর সঙ্গে পরিবারের লোকেদের যোগাযোগ ছিল। মাঝেমধ্যে সে বাড়িতেও আসত। যদিও ধৃত রামপদর বাবা চণ্ডীচরণবাবু বলেন, ‘‘রামপদকে নিয়ে আমরা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলাম। তাই ওকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলাম। তারপর থেকে ওর সঙ্গে তেমন যোগাযোগও ছিল না। ওইদিন রাতে ও আমাদের বাড়িতেও আসেনি। ঘটনার কথা আমরা জানতেই পারিনি।’’ ঘটনার দিন সে বাড়িতে গিয়েছিল কি না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy