Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

খালি পায়ে ছুটে স্বপ্নের কাছাকাছি

এক জন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। বয়স ৮৩। অন্য জন ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী। বয়স ১২। এলাকার ছেলেমেয়েদের খেলাধুলোয় আগ্রহী করে ৮৩ বছরেও নিরলস ওই শিক্ষক স্বপ্ন দেখেন সুষ্ঠ সমাজ গড়ার। সেই পথে বাধার মুখে পড়েও হাল ছাড়েননি।

আদুরি খাতুন ও রেজা রাজি।— নিজস্ব চিত্র

আদুরি খাতুন ও রেজা রাজি।— নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
চাঁচল শেষ আপডেট: ২৫ নভেম্বর ২০১৬ ০২:৩৭
Share: Save:

এক জন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। বয়স ৮৩। অন্য জন ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী। বয়স ১২। এলাকার ছেলেমেয়েদের খেলাধুলোয় আগ্রহী করে ৮৩ বছরেও নিরলস ওই শিক্ষক স্বপ্ন দেখেন সুষ্ঠ সমাজ গড়ার। সেই পথে বাধার মুখে পড়েও হাল ছাড়েননি। গ্রাম-গঞ্জ থেকে খেলাধুলোয় প্রতিভাবানদের খুঁজে বের করতে এখনও ছুটে চলেছেন তিনি।

অন্য জনের বাবা দিনমজুর। সংসারের অভাবে দুই দাদাকে পড়া ছেড়ে ভিন রাজ্যে শ্রমিকের কাজে যেতে হয়েছে। কিন্তু বছর বারোর সেই বালিকা গত ১৫ অগস্ট ম্যারাথন প্রতিযোগিতায় খালি পায়ে দৌড়ে প্রথম হয়ে সবাইকে চমকে দিয়েছে। পড়াশুনার পাশাপাশি ছুটতে ছুটতে যে পৌঁছাতে চায় স্বপ্নের কাছাকাছি।

ওই দুজনের একজন রেজা রাজি, অন্যজন আদুরি খাতুন।

দু’জনেরই বাড়ি মালদহের হরিশ্চন্দ্রপুরের প্রত্যন্ত এলাকায়। কিন্তু হরিশ্চন্দ্রপুরের সীমানা ছাড়িয়ে যাদের অদম্য লড়াইয়ের কাহিনি এখন প্রায় গোটা জেলার মানুষেরই জানা। আর এবার সেই সীমানা ছাড়িয়েও মিলল স্বীকৃতি। অসম বয়সী ওই দুই লড়াকু এবার দ্য টেলিগ্রাফ স্কুল অ্যাওয়ার্ড ফর এক্সসেলেন্স-এর জন্য মনোনীত হয়েছেন। আগামী শনিবার কলকাতা সায়েন্স সিটি অডিটোরিয়ামে আয়োজিত অনুষ্ঠানে তাঁদের সম্মানিত করা হবে। তাদের সম্মানিত হওয়ার খবর পৌঁছতেই খুশির আবহ তৈরি হয়েছে এলাকা জুড়ে। সারা জীবনের স্বীকৃতি স্বরূপ রেজা রাজি ডক্টর (মিসেস) এন বি ও ব্রায়েন মেমোরিয়াল লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড ফর এ টিচারের সম্মান আর আদুরিকে দেওয়া হবে বিশেষ বৃত্তি। গত ২১ বছর ধরেই অসামান্য প্রতিভাকে স্বীকৃতি দিয়ে আসছে দ্য টেলিগ্রাফ এডুকেশন ফাউন্ডেশন।

রেজা রাজি বা আদুরি-লড়াইয়ের পথ আজও তাদের কাছে মসৃণ নয়। প্রত্যন্ত শেখপাড়ার আদুরিকে প্রতিদিন পাঁচ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যেতে হয়। চণ্ডীপুর হাইস্কুলে পড়াশোনার পাশাপাশি সময় পেলেই দৌড়নো তার নেশা। বাবা রবিউল ইসলাম দিনমজুর। দুই ছেলেকে পড়াতে পারেননি। তারা ভিনরাজ্যে শ্রমিকের কাজ করেন। কিন্তু পড়াশুনার প্রতি মেয়ের আগ্রহ দেখে তাকে স্কুলে না পাঠিয়ে পারেননি। একটু বড় হয়েই তারা দেখেন যে আদুরি আপন খেয়ালে ধানের জমি, গ্রামের রাস্তায় ছুটছে। জুতো কিনে দেওয়ারও সামর্থ ছিল না বাবার। মেয়েটা পাগল বলে অনেকেই টিটকিরি দিত। কিন্তু তা আদুরিকে দমাতে পারেনি। ফলস্বরূপ গত ১৫ অগস্ট চাঁচলে আয়োজিত ম্যারাথন প্রতিযোগিতায় খালি পায়ে দৌড়ে প্রথম হয় সে।

আদুরির মা রূপসানা বিবি বলেন, ‘‘মেয়েটা সময় পেলেই ছুটতে থাকে। দু’বেলা পেট ভরে খেতেও দিতে পারি না।’’ আর রেজা রাজি, ছিলেন জীবন বিজ্ঞানের শিক্ষক। কিন্তু জীবন গঠনে খেলাধুলা কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা জেনে এলাকায় ক্লাব গড়ে খেলাধুলার প্রসারে উদ্যোগী হন। অবসরের পর দু’দশক পেরিয়েও তার লড়াই চলছে। গ্রামের প্রতিভা খুঁজে বের করতে, বিশেষ করে মেয়েদের খেলাধুলায় আগ্রহী করে তুলতে মহকুমা জুড়েই একের পর এক নানা খেলাধুলোর আয়োজন করে চলেছেন। বছর দু’য়েক আগে নিজের গ্রাম চণ্ডীপুরে মেয়েদের ফুটবল খেলার আয়োজন করেছিলেন। কিন্তু আঁটো পোশাকে মেয়েরা ফুটবল খেলবে, তাই এক শ্রেণির মানুষের বাধায় তা ভেস্তে যায়। তাকে নিগ্রহেরও শিকার হতে হয়। কিন্তু পিছিয়ে আসেননি তিনি। তাঁর আয়োজিত খেলা দেখেই একসময় খেলাধুলোয় আগ্রহী হয়ে ছুটতে শুরু করে আদুরি।

রেজা রাজি বলেন, ‘‘প্রত্যন্ত গ্রামে থেকে এমন সম্মান কোনওদিন পাব ভাবিনি। ওই সম্মান আমাকে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার প্রেরণা দেবে।’’ আর আদুরি জানায়, ‘‘দৌড়াতে খুব ভালো লাগে যে, কী করব। তাই সময় পেলেই ছুটতে থাকি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

School student Teacher Runner
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE