সোমবার রাত থেকে একটানা বৃষ্টি। মঙ্গলবার দুপুরের মধ্যে বিপর্যস্ত প্রায় গোটা উত্তরবঙ্গ। আর রাতের দিকে জল ঢুকতে শুরু করল জলপাইগুড়িতে। তার আগেই ডুয়ার্সের বিভিন্ন নদী উপচে উঠতে শুরু করেছে। জল ঢুকছে বহু এলাকায়। শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, মালবাজার, আলিরপুরদুয়ার, দুই দিনাজপুর, মালদহের বিভিন্ন অঞ্চলে নিকাশির অবস্থা বেহাল বলে অভিযোগ তুলেছেন এলাকার বাসিন্দারা। এই দোষারোপেরও পিছনেও আবার দু’ধরনের ছবি। আলিপুরদুয়ারের মানুষ যেমন বলেছেন, নিকাশি নালা নেই বলে তাঁদের এই দুর্দশা, উল্টো দিকে তেমনই শিলিগুড়ির বাসিন্দাদের অভিযোগ, নিকাশি নালা সংস্কার করা হচ্ছে না বলেই ডুবছে শহর! জল বাড়তে থাকায় ডুয়ার্সের জলঢাকা, ডুডুয়া, গিলান্ডি নদীতে হলুদ সতর্কতা জারি করা হয়েছে।
শিলিগুড়িতে বড় কোনও ক্ষয়ক্ষতি না হলেও এক নম্বর ওয়ার্ডের অম্বেডকর কলোনি, লাগোয়া অম্বিকানগর, ফকদইবাড়ি, ৩১ ও ৩২ ওয়ার্ডের অশোকনগর, সুকান্তপল্লি, ৪৬ নম্বরের রাজীবনগর, ৩৪ নম্বর ওয়ার্ডের সূর্য সেন কলোনি-সহ একাধিক এলাকায় হাঁটু সমান জল ছিল। গুরুঙ্গবস্তিতে একটি কালভার্ট জলের তোড়ে ভেঙে যায়। পরিস্থিতি মোকাবিলায় বৈঠকে বসেন শিলিগুড়ির মেয়র অশোক ভট্টাচার্য। সমস্ত পুরকর্মীর ছুটি বাতিল করে ২৪ ঘণ্টা নজর রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
জলমগ্ন জলপাইগুড়ি শহরের দিনবাজার এলাকাও। সন্ধ্যার পরে করলা নদীর জল উপচে দিনবাজারে ঢুকে পড়ে। বেশ কিছু দোকানপাট, ঘরদোরে জল ঢুকে যায়। পাহাড়ে টানা বৃষ্টির ফলে বৈকণ্ঠপুর জঙ্গল ভাসিয়ে জল ঢুকে পড়ে করলায়। তার পরেই সন্ধ্যায় দিনবাজার প্লাবিত হয়। ওই এলাকার ব্যবসায়ীদের অনেকের অভিযোগ, জল জমতে পারে, এ কথা মাথায় রেখেই নিকাশির ব্যবস্থা করা উচিত ছিল। কিন্তু পুরসভা তা করেনি। উপরন্তু করলার বাঁধও যথেষ্ট উঁচু নয়। তাই এই বিপত্তি।
বর্ষার দাপট ছড়িয়ে গিয়েছে ডুয়ার্স ও পার্শ্ববর্তী এলাকাতেও। রাতভর ভারী বৃষ্টি হওয়ায় কার্যত জলবন্দি হয়ে পড়ে হ্যামিল্টনগঞ্জের বাসিন্দারা। প্রবল বৃষ্টির জেরে সাতালি চাবাগানের কাছে একটি কালভার্ট ভেঙে যানচলাচল ব্যাহত হয়। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান , রাত দুটো নাগাদ জল বাড়তে শুরু করে। শ্যামাপ্রসাদ কলোনি, সুভাষপল্লি, বাবুপাড়া, কালীবাড়ি মাঠ, নেতাজি পল্লিতে সকাল ন’টা পর্যন্ত জল দাঁড়িয়েছিল। বিডিও অফিসের কাছে একটি গাছ পড়ে বেলা বারোটা পর্যন্ত রাস্তা বন্ধ ছিল। আলিপুরদুয়ার জেলা পরিষদের সভাধিপতি মোহন শর্মা জানান, বড় নিকাশি নালা না থাকায় ভারী বৃষ্টিপাতের ফলে জল জমে যাচ্ছে এলাকায়। বিষয়টি নিয়ে চিন্তাভাবনা চলছে। নিকাশি নালা তৈরির জন্য জায়গা খোঁজা হচ্ছে।
এক বেলার বৃষ্টিতেই ভোগান্তির মুখে পড়ছেন কোচবিহার শহরের বিস্তীর্ণ এলাকার বাসিন্দারা। বাসিন্দাদের অবশ্য অভিযোগ, টানা বৃষ্টি হলেই কোচবিহারের কেশব রোড, সুনীতি রোড, ব্যাঙচাতরা রোড, কালিকাদাস রোড, বিশ্ব সিংহ রোড বাই লেন, সিলভার জুবিলি রোড বাই লেন-সহ বিস্তীর্ণ এলাকায় ফি বছর জল দাঁড়িয়ে যায়। এ বার বর্ষার শুরুতে কিছু এলাকায় ওই সমস্যা ফের সামনে এসেছে। সোমবারেও কেশব রোডের বিস্তীর্ণ এলাকায় জল দাঁড়িয়ে থাকায় বাসিন্দারা ব্যাপক সমস্যায় পড়েন।
রাত থেকে বৃষ্টিতে উত্তর দিনাজপুরের ইসলামপুর কলেজের সামনের রাস্তায় জল জমে যায়। সেই জলকাদা ভেঙে স্কুল-কলেজে যেতে হচ্ছে ছাত্রছাত্রীদের। ইসলামপুর হাসপাতাল এলাকা, খ্রিস্টানপাড়া, ফার্ম কলোনির প্রাইমারি স্কুল মাঠ জলমগ্ন ছিল দুপুর পর্যন্ত।
মালবাজারে নতুন আন্ডারপাসে জল জমে যায়। জলে আটকে পড়ে একটি স্কুল পড়ুয়াদের নিয়ে যাওয়া পুলকারটি। গাড়িতে জল ঢুকছে দেখে বাসিন্দারা দমকলে খবর দেন। পরে দমকলের একটি ইঞ্জিন এসে দড়ি দিয়ে টেনে পড়ুয়া সমেত গাড়িটিকে উদ্ধার করে। যে স্কুলের পড়ুয়ারা ওই গাড়িতে ছিল, তার অধ্যক্ষ দিলীপ সরকার ঘটনায় রীতিমতো আতঙ্কিত। তাঁর কথায়, রোজ ওই আন্ডারপাস দিয়ে পড়ুয়াদের যাতায়াত করতে হয়। এখন সেখানে যা জল জমছে, তাতে বড় কোনও বিপদ ঘটে যেতেই পারে। তবে আন্ডারপাসের জল কে সরাবে, রেল না পুরসভা— তা নিয়েই তরজা শুরু হয়েছে। রেলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এই ধরনের পরিষেবামূলক কাজের দায়িত্ব পুরসভারই। উল্টো দিকে মালবাজার পুরসভার চেয়ারম্যান স্বপন সাহার দাবি, জল সরানোর দায়িত্ব নিতে হবে রেলকেই। তিনি বলেন, ‘‘যাঁরা নির্মাণ করিয়েছেন, তাঁরাই জল বের করার কারিগরি ভাল জানেন। আমাদের পক্ষে তা জানা সম্ভব নয়।’’
এ দিন তিস্তা এবং ধরলায় জল বাড়ায় ঘটায় নতুন করে জলবন্দি হয়ে পড়েছেন মালবাজার এবং ময়নাগুড়ি ব্লকের হাজার পাঁচেক পরিবার। জল বাড়ছে লিস, ঘিস, চেল, মাল, নেওড়া, কুর্তি, মূর্তি, জলঢাকা প্রতিটি নদীতেই। বিন্নাগুড়ি এলাকায় হাতিনালার খালের জল ঢুকে বেশ কিছু বাড়িঘর প্লাবিত। বিন্নাগুড়ি হাই ও হিন্দি প্রাথমিক স্কুলেও জল ঢুকে পড়ায় স্কুল ছুটি দিয়ে দিতে হয়। প্রাথমিক স্কুলে এ দিন পরীক্ষা থাকলেও স্কুলে জল ঢুকে যাওয়ায় পরীক্ষা বাতিল হয়। প্লাবিত হয়েছে এলাকার তিনটি চা বাগানও। ধূপগুড়ির বিডিও শুভঙ্কর রায় বলেন, “ব্লক বিপর্যয় মোকাবিলা আধিকারিক এলাকায় বন্যা পরিস্থিতি দেখেছেন। ত্রিপলের ব্যবস্থা করতে বলা হয়েছে। গ্রাম পঞ্চায়েতকে প্রাথমিক ত্রাণ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।”