বার অ্যাসোসিয়েশনে জয়ের পর উল্লাস কংগ্রেস-সিপিএম জোটের সদস্য ও পদাধিকারীরা।
ক্ষমতা দখল করতে হুমকি, তৃণমূল আইনজীবী সেলের নেতাদের একাংশের ঔদ্ধত্য— এ সব নিয়ে অভিযোগ ছিল। আদালত চত্বরে শাসক দলের আইনজীবী সেলের নেতাদের হাবভাব থাকত অন্য রকম। অভিযোগ, তাঁরাই যে জিতবেন হাবেভাবে সেটাই তাঁরা বোঝাতেন। আবার তাঁদের কিছু নেতা যেটা বলবেন সেটাই কার্যকর হতো, অন্যদের মতামত গুরুত্ব পেত না বলেও অভিযোগ। সদ্য কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দেওয়া নিলয় চক্রবর্তী নামে এক আইনজীবীকে সম্পাদক পদে লড়ার সুযোগ করে দেওয়া নিয়েও দলের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়। ওই নেতা দলে এসেই সুযোগ নেবেন আর অন্যরা দীর্ঘদিন ধরে লড়েও সুযোগ পাবেন না কেন, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। কয়েক জন নেতার মতকেই কেন প্রধান্য দিতে হবে, তা নিয়েও ক্ষোভ তৈরি হয়। এমনকী, ওই প্রার্থীর বিরুদ্ধে তৃণমূলের আইনজীবী সেলের এক নেতা মনোনয়নও জমা দেন। যদিও পরে তিনি প্রত্যাহার করে নেন।
মহুরিদের মতামত না নিয়েই জোর করে তাদের অন্যত্র সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা নিয়েও অভিযোগ রয়েছে। তা নিয়ে আদালত চত্বরে শাসক দলের বিরুদ্ধে ক্ষোভ বাড়ছিল। এমনকী অভিযোগ, একটি ম্যাগাজিন প্রকাশের সম্ভাবনাকে ঘিরে বার অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাচনের দায়িত্ব যে আধিকারিককে রয়েছেন তৃণমূলের কথা না শুনলে তাঁকে নির্বাচন না করতে দেওয়ার হমকিও দেওয়া হয়েছিল শাসক দলের আইনজীবী সেলের নেতাদের একাংশের তরফে। দলের নেতারাই পিছনে থেকে এ সবে মদত দিয়েছেন বলে অভিযোগ। তা ভাল চোখে নেননি অনেকেই। তৃণমূলের আইনজীবী সেলের নেতাদের ঠেকাতে জোট বাঁধে কংগ্রেস আইনজীবী সেল এবং বাম মনোভাবাপন্ন আইনজীবীদের সংগঠন।
নিজেদের কর্তৃত্ব কায়েম করতে বিভিন্ন আইনজীবীদের ফোন করে হুমকি দেওয়ার অভিযোগও উঠেছে গৌতম দেবের বিরুদ্ধে। গত শনিবার নির্বাচনের দিনও আদালত চত্বরে গৌতম দেব থেকে নান্টু পাল, কৃষ্ণ পাল, বিকাশ সরকারদের মতো অনেক নেতাকেই দেখা গিয়েছিল। বিরোধী শিবিরের অনেকেরই নজরে পড়েছে তৃণমূলের নেতারা ঘনঘন ফোন করছেন। কখনও কৃষ্ণবাবু ফোন করছেন ঘনিষ্ঠ আইনজীবীদের। কখনও পরিচিত আইনজীবীর সঙ্গে মোবাইল নিয়ে কথা বলতে দেখা গিয়েছে বিকাশ সরকারদের। গৌতমবাবু ফোন ওঠালেই কয়েক জন আইনজীবী নেতা ঘনিষ্ঠ সতীর্থদের কাছে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে জানিয়েছেন, গৌতমবাবু যখন হাত দিয়েছেন তখন শেষ দেখেই ছাড়বেন। তাঁরা শিবির করে বসেছিলেন। অন্য দিকে বিরোধীদের শিবিরে একসঙ্গে দেখা গিয়েছে কংগ্রেস সেলের গঙ্গোত্রী দত্ত, বাম সংগঠনের কমল অগ্রবালদের মতো আইনজীবীদের। ছিলেন পার্থ চৌধুরীও। তাঁরাও জোটবদ্ধ হয়ে লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন।
দিনের শেষ শিলিগুড়ি বার অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাচনে তৃণমূলের ভরাডুবি হয়েছে। বার অ্যাসোসিয়েশনের ১৫টি আসনের মধ্যে ১৪টি-ই পেয়েছে জোটের প্রার্থীরা। তৃণমূল সেলের একজন আইনজীবী একজিকিউটিভ কমিটির সদস্য পদে জিতেছেন। বাকি সমস্ত পদ এবং একজিকিউটিভ কমিটির ৯টির মধ্যে বাকি আটটি পদ সবই জোটের প্রার্থীদের দখলে। তৃণমূলের আইনজীবী সেলের নিলয়বাবু পেয়েছেন ৩৮৫টি ভোট। আর তাঁকে হারিয়েছেন জোটের প্রার্থী উদয় শঙ্কর মালাকার। তিনি পেয়েছেন ৫০৬টি ভোট। কংগ্রেসের আইনজীবী সেলে থাকার সময় তিনি একবার সম্পাদক হন, দু’বার সহকারী সম্পাদক, দু’বার একজিকিউটিভ সদস্যও ছিলেন। তিনি বলেন, ‘‘হারের দায় নিজেই নিচ্ছি। আইনজীবীদের সমর্থন পাইনি। অতীতে বার অ্যাসোসিয়েশনের ক্যান্টিন-সহ যে সমস্ত উন্নয়ন কাজ করেছি তা হয়তো তারা পছন্দ করছেন না।’’ আর কমল অগ্রবাল, গঙ্গোত্রী দত্তরা বলছেন, ১৯ তারিখ ইভিএম খুললে বিধানসভা ভোটেও এই ফলই দেখা যাবে। শুরুটা হল শিলিগুড়ি থেকে। বার অ্যাসোসিয়েশনের অনেকেই বলছেন, শিলিগুড়ির শিক্ষিত লোকেরাও যে তৃণমূলকে আর চাইছে না, এই ফল তারই ইঙ্গিত দিল।
মন্ত্রী হওয়ার সময় বার কাউন্সিলে নিজের সদস্য পদ আপাতত সাসপেন্ড রাখার জন্য তিনি আবেদন করেছিলেন। সেই মতো তাঁর সদস্যপদ সক্রিয় নয়। শিলিগুড়ি বার অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য হলেও নৈতিকতার দিক থেকে তাই তিনি ভোট দেননি বলে জানিয়েছেন গৌতম দেব। বলেছেন, ‘‘বার অ্যাসোসিয়েশনের ভোটে আমাদের আইনজীবীরা লড়ছেন। তাঁদের পাশে তো থাকতেই হবে। আমি বার অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য সেই হিসাবে কাউকে ফোন করতেই পারি। তবে বিধানসভা নির্বাচন পরিস্থিতিতে সেই সময় সুযোগও হয়নি। ভোটে আমাদের হার নিয়ে যাঁরা দায়িত্বে ছিলেন তাঁদের সঙ্গে কথা বলেছি। নিশ্চয়ই দল বিষয়টি খতিয়ে দেখবে।’’ তবে তাঁর দাবি, শিলিগুড়ি বার অ্যাসোসিয়েশনে বরাবরই কংগ্রেস আইনজীবী সেল শক্তিশালী। বাম জমানাতেও শিলিগুড়ি বার অ্যাসোসিয়েশনে তারাই ক্ষমতায় থেকেছে। গত বার কোনও জোট ছিল না। তৃণমূল আইনজীবী সেলের প্রার্থীরা দ্বিতীয় স্থানে ছিলেন। এ বার কংগ্রেস এবং বাম শিবির জোট করায় স্বাভাবিক ভাবেই এগিয়েছে বলে গৌতমবাবুর মত।
তৃণমূলের আইনজীবীদের এই হার নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে দলের অন্দরেই। গত কয়েক বছরই খারাপ ফল হয়েছে তৃণমূল আইনজীবী সেলের। তার পরেও যাঁরা দায়িত্বে রয়েছেন, তাঁদের সরানো হয়নি। বরং তাঁদের দাপট বেড়েছে। আদালতে সরকারি আইনজীবী তালিকায় যাঁরা রয়েছেন, সেখানেও তাঁদের হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত থাকা অনেকেই পছন্দ করতেন না। তৃণমূলের আইনজীবী সেল এবং দলের একটি সূত্রই মনে করছে, নিজেদের মধ্যে কোন্দল, সমন্বয়ের অভাব দূর করতে না পারায় তার মাসুল দিতে হচ্ছে বার অ্যাসোসিয়েশনের ভোটে।
পশ্চিমবঙ্গ তৃণমূল কংগ্রেস আইনজীবী সেলের সভাপতি পীযূষ ঘোষ বলেন, ‘‘রাজনীতি করে হারানো হল। আদালত রাজনীতি করার জায়গা নয়। যাঁরা এটা করছেন তারা এখানকার পরিবেশ নষ্ট করছেন। আমরা কোনও রাজনীতি করিনি। কাউকে হুমকি দেওয়ার কোনও ব্যাপার নেই।’’ বিরোধী শিবিরের অভিযোগ, মুখে বললেই হল না, ভোটের দিন তাদের নেতামন্ত্রীরা এসে ভোট করিয়েছেন। দার্জিলিং জেলা কংগ্রেস আইনজীবী সেলের অন্যতম সদস্য তথা প্রাক্তন মেয়র গঙ্গোত্রী দত্ত বলেন, ‘‘নির্বাচনের দিন তৃণমূলের নেতারা তো দীর্ঘক্ষণ আদালত চত্বরেই বলে ছিলেন। ভোট কেমন হচ্ছে নজরদারি করছিলেন। কিন্তু তাঁরা সমর্থন পাননি।’’ তৃণমূল হঠাতে রাজ্য রাজনীতিতে যে জোটের সমীকরণ তৈরি হয়েছে, তা বাড়তি মাত্রা যোগ করেছে শিলিগুড়ি বার অ্যাসোসিয়েশনের ভোটেও। জোটের প্যানেল থেকে দাঁড়িয়ে সভাপতি পদে জয়ী সুরেশ মিত্রুকার কথা, ‘‘রাজ্য রাজনীতিতে জোট হয়েছে। সেই নিয়মে আমরাও এখানে জোটবদ্ধ হয়ে লড়েছি। তাতে ফল মিলেছে।’’ বাম মনোভাবাপন্ন সারা ভারত আইনজীবী ইউনিয়নে সর্বভারতীয় সহসভাপতি মিলন সরকার বলেন, ‘‘৯০শতাংশের উপরে সদস্য ভোট দিয়েছেন। যেটা দেখা যায়, অতিরিক্ত ভোট দান রাজ্যে শাসক-বিরোধী হিসেবেই কাজ করে। এখানেও তাই হয়েছে। জোটের ফলে জেতার ব্যবধান বেড়েছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy