Advertisement
১৮ মে ২০২৪

অমাবস্যার হুঙ্কার

অমাবস্যার রাত যত বেড়েছে, শব্দদৈত্য ততই হুঙ্কার বাড়িয়েছে। ঘড়ির কাঁটায় তখন শনিবারের মধ্য রাত পেরিয়ে গিয়েছে। মণ্ডপে মণ্ডপে ঢাক কাঁসরের শব্দ চাপা পড়ে গিয়েছে একটানা শব্দবাজির শব্দে। বাড়ির দরজা-জানলা বন্ধ করেও বাজির বুক কাঁপানো শব্দ আটকাতে পারেননি বাসিন্দারা। হাসপাতাল-নার্সিংহোম এলাকাও ছাড় পায়নি শব্দের তাণ্ডব থেকে। রাত একটা, দু’টো—সময়ের তোয়াক্কা না করেই কালীপুজোর রাতে নিষিদ্ধ শব্দবাজি কাঁপিয়ে দিয়েছে উত্তরের জেলাগুলিকে। বাসিন্দাদের একাংশের প্রশ্ন, ‘‘তবে এত দিন পুলিশ কেমন নজরদারি চালাল? কতই বা বাজি বাজেয়াপ্ত করল?’’ কালীপুজোর রাতে নিষিদ্ধ বাজি পুড়িয়ে শব্দ দুর্ভোগকে টেক্কা দিল উত্তরের কোন কোন শহর? কোন পাড়া? খোঁজ নিল আনন্দবাজার।

এ ভাবেই যত্রতত্র শব্দ-তাণ্ডব। জলপাইগুড়িতে নিজস্ব চিত্র।

এ ভাবেই যত্রতত্র শব্দ-তাণ্ডব। জলপাইগুড়িতে নিজস্ব চিত্র।

শেষ আপডেট: ৩১ অক্টোবর ২০১৬ ০২:২৪
Share: Save:

অমাবস্যার রাত যত বেড়েছে, শব্দদৈত্য ততই হুঙ্কার বাড়িয়েছে। ঘড়ির কাঁটায় তখন শনিবারের মধ্য রাত পেরিয়ে গিয়েছে। মণ্ডপে মণ্ডপে ঢাক কাঁসরের শব্দ চাপা পড়ে গিয়েছে একটানা শব্দবাজির শব্দে। বাড়ির দরজা-জানলা বন্ধ করেও বাজির বুক কাঁপানো শব্দ আটকাতে পারেননি বাসিন্দারা। হাসপাতাল-নার্সিংহোম এলাকাও ছাড় পায়নি শব্দের তাণ্ডব থেকে। রাত একটা, দু’টো—সময়ের তোয়াক্কা না করেই কালীপুজোর রাতে নিষিদ্ধ শব্দবাজি কাঁপিয়ে দিয়েছে উত্তরের জেলাগুলিকে। বাসিন্দাদের একাংশের প্রশ্ন, ‘‘তবে এত দিন পুলিশ কেমন নজরদারি চালাল? কতই বা বাজি বাজেয়াপ্ত করল?’’ কালীপুজোর রাতে নিষিদ্ধ বাজি পুড়িয়ে শব্দ দুর্ভোগকে টেক্কা দিল উত্তরের কোন কোন শহর? কোন পাড়া? খোঁজ নিল আনন্দবাজার।

যেন যুদ্ধভূমি

শিলিগুড়ির শব্দদৈত্যের তাণ্ডব ছাপিয়ে গেল উত্তরবঙ্গের অন্য জেলাগুলিকে। রবিবার বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হতেই শুরু হয়ে যায় শব্দবাজির দাপাদাপি। চার্চরোড, সেবক রোড থেকে পঞ্জাবিপাড়া, হাকিমপাড়া, আশ্রমপাড়া, দুইমাইল, খালপাড়া, নয়বাজার, স্টেশন ফিডার রোড, প্রধাননগর এলাকায় বাজির আওয়াজে কাঁপতে থাকে। সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ১টা অবধি শহরের কানপাতাই দায় হয়ে পড়ে। পুলিশের ভ্যানের দৌড়াদৌড়ি থাকলেও রাস্তার বদলে বাড়ির ছাদ, ব্যালকনি বা ভিতরে বাজি ফাটানো চলে থাকে। আকাশের রং লাল, হলুদ, সবুজ বদলাতে থাকে। সঙ্গে প্রচণ্ড শব্দ। অনেক এলাকায় পাশাপাশি বাড়ির ছাদ থেকে চলে বাজি ফাটানোর প্রতিযোগিতা। অনেকেই একে কারগিলের যুদ্ধ বা সার্জিক্যাল অ্যাটাক হচ্ছে, তা বলেও বিদ্রুপ করেন। প্রবীণেরা তো বটেই কচিকাঁচারাও টানা শব্দে অস্বস্তি বোধ করেন। বেশ কিছু এলাকায় রাস্তায় আটকেও বাজি ফাটানোর ধুম দেখা দিয়েছে। পুলিশের দাবির পরেও শহর জুড়ে এত শব্দবাজি কী ভাবে ঢুকে বিক্রি হল তা নিয়ে প্রশ্নও তুলেছেন বহু বাসিন্দা। মণ্ডপের ধুপধুনো, মিঠাইয়ের দোকানের ঘি-কড়াপাকের গন্ধ উধাও শিলিগুড়ির হাকিমপাড়া হোক বা সুভাষপল্লি রাত বারোটার আগে থেকেই বাতাসে বারুদের ঘ্রাণ। নাগাড়ে বাজি পোড়ায় বাতাস জুড়ে বারুদ ভাসছে। শুধু বারুদের ঘ্রাণ নয়, শব্দবাজির টানা শব্দে খালপাড়া-নয়াবাজার, শক্তিগড়, স্টেশন ফিডার রোডের এলাকায় প্রায় যুদ্ধ পরিস্থিতি। নিষিদ্ধ চকোলেট বোমের শব্দ যেন পেটো, বাক্সবোমার শব্দের সঙ্গে তুলনা হতে পারে গ্রেনেডকে। রাত দশটার পরে শব্দবাজি দিয়ে যেন ‘এলাকা দখল’ নেওয়ার পালা চলে। রাস্তার এক দিকের সঙ্গে অন্যদিকের বাজি ছুড়ে লড়াই, এমনকী বহুতলগুলির মধ্যে যেন বাজি পোড়ানো নিয়ে প্রতিযোগিতা চলছিল।

ভূমিকম্প নাকি?

রাত সাড়ে ১১টা। মালদহের বেলতলা এলাকার বাড়িগুলির কাচের জানালা কেঁপে উঠতে থাকে। জানালার পাশে রাখা শো-কেসের ওপরে পুতুল উল্টে যায় কাঁপুনিতে। থরথর করে কাঁপতে থাকে ফুলদানি। বাজির শব্দ হয়েই চলছিল রাত থেকে। সাড়ে এগারোটা থেকে শুরু হয় ক্রমাগত বাজি পোড়ানো। চকোলেট বোম, দোদমা, এমনকী তীব্র শব্দ করা হাউই বাজি টানা পোড়ানো শুরু হয়। বেলতলার রাস্তায় প্রতিটি জটলা থেকেই চলছে বাজি পোড়ানো। তার বেশিরভাগই নিষিদ্ধ শব্দবাজি বলে অভিযোগ। ফুলবাড়িতেও কিছু পর থেকে আসতে থাকা টানা শব্দ। এক বধূ দীপ্তি দাস বলেন, ‘‘প্রথমে তো ভেবেছিলাম ভূমিকম্প হচ্ছে।’’

সংযমী বালুরঘাট

শব্দবাজির প্রতিযোগিতায় না ছুটে এবার কালীপুজোর রাতে সংযম দেখালো বালুরঘাট। পাড়ায় পাড়ায় শব্দবাজির সেই পরিচিত দৌরাত্ম্য এবং কান ঝালাপালা করা দেদার শব্দবাজির বদলে মাঝেমধ্যে ঠাসঠুস লঙ্কা পটকা ছাড়া চকোলেট বোমা কিংবা দোদমার শব্দ প্রায় শোনাই যায়নি। তার বদল হাউই, রকেট ফটকা তুবড়ি তারাবাতি এবং রংমশলাতেই মজে ছিলেন বালুরঘাটের বাসিন্দারা। আকাশে উড়েছে রঙবেরঙের ফানুস।

দুপুরে ফের শুরু

রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে চকোলেটে ও লঙ্কার দাপট। শনিবার রাত দশটা থেকে এগারোটা পর্যন্ত আলিপুরদুয়ার শহরের বিভিন্ন অংশে ফাটতে শুরু করে নিষিদ্ধ বাজি। রাত ১টা থেকে ২টো পর্যন্ত অবিরাম ফাটতে থাকে বাজি। রবিবার দুপুর থেকে ফের শুরু হয় শব্দ বাজির দাপট। চলে রাত পর্যন্ত।

যত শব্দ, তত তালি

রাত এগারোটার পরে সুনসান হয়ে গিয়েছিল কোচবিহারের রেলগুমটি এলাকা। সারা দিন শব্দ-তাণ্ডবের পরে স্বস্তি পেয়েছিলেন বাসিন্দারাও। হঠাৎই একদল যুবক গুমটিতে জড়ো হয়ে বাজি পোড়ানো শুরু করে বলে অভিযোগ। চলে রাত আড়াইটে পর্যন্ত। শুধু মানুষ নন গবাদি পশুরাও আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। একটি বাড়ির পোষা কুকুর যত ক্ষণ বাজি পুড়েছে আতঙ্কে তারস্বরে চিৎকার করতে শোনা গিয়েছে। রবীন্দ্রনগরের মাঠে যেন চকোলেট বোম ফাটানোর প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিল। যার বোমের যত শব্দ হয়েছে, সে তত বেশি হাততালি পয়েছে। মারুগঞ্জে ৩১ নম্বর জাতীয় সড়ক আটকে বাজি পোড়ানো চলেছে। প্রায় এক ঘণ্টা রাস্তায় যান চলাচল বিপর্যস্ত হয়। পরিবেশবিদ অরূপ গুহ বলেন, ‘‘মনে হচ্ছিল বিমান থেকে বুঝি বোমা ফেলা হচ্ছে।’’

টেক্কা দিল মোহনবাটী

রাত ৯টার পর একটির পর একটির দোকানের শাটার নামতে থাকে রায়গঞ্জের মধ্য মোহনবাটী এলাকার। তারপর গোটা এলাকাটি যেন হয়ে ওঠে নিষিদ্ধ শব্দবাজির মুক্তাঞ্চল। কেউ বাধা দেওয়ার নেই, কেউ বারণ করার নেই। তবে পুলিশ তিন জনকে ধমকে বাজি কেড়ে নিয়েছে বলে দাবি করেছে। কিন্তু তাতে কী ফল হয়েছে, তা নিয়ে বাসিন্দারাই সন্দিহান। বাইক-গাড়ি-টোটো চলাচল বন্ধ হয়ে গিয়েছে মধ্য মোহনবাটীর রাস্তায়। বারোটার পরে বাজির মুক্তাঞ্চল হয়ে হয়ে ওঠে মোহনবাটী।

বাজির লড়াই

সন্ধ্যা নাগাদ প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিল দেশবন্ধু পাড়া এবং পাণ্ডাপাড়ার মধ্যে। এই পাড়ায় টানা দশ মিনিট চকোলেট বোম ফাটার পরে, ও পাড়ায় হাজার লঙ্কার চেন পোড়ানো শুরু হল। প্রতিযোগিতার মাপকাঠি হয়ে উঠল শব্দবাজিই। টু সাউন্ড থেকে টুয়েলভ সাউন্ড কান পাতাই দায় হয়ে ওঠে বাসিন্দাদের। বাজি ফুরিয়ে যেতেই বাইকে অথবা টোটো ভাড়া করে যুবক থেকে মাঝ বয়সীদের দল ছুটছে দোকানে, এমন দৃশ্যও দেখা গেল পাণ্ডাপাড়ায়। রাত বাড়তেই প্রতিযোগিতার ব্যাটন নিল দিনবাজার। দিনবাজার থেকে কোতায়ালি থানা খুব দূরেও নয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

North Bengal Kali Puja Sound Pollution
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE