Advertisement
E-Paper

পার হয়ে যায় গরু

এখানে এঁকে হাত করে গাড়ি পেরিয়ে যায়। আরেক জায়গায় প্রভাবশালী কর্তাকে রসেবশে রেখে সীমান্তে পৌঁছে যায় গাড়ি। সীমান্তরক্ষীদের নজর এড়াতেও নানা কায়দা রয়েছে। উত্তরবঙ্গের ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত কান পাতলে এমনই শোনা যায়। বাসিন্দাদের হাতে-গরম অভিজ্ঞতা তুলে ধরল আনন্দবাজার।গরু সীমান্তের দিকে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে দু’ধরনের লোককে কাজে নামানো হয়। একজন ‘ডাঙ্গোয়াল’। এরা গরুর সঙ্গেই থাকে। আরেকজন ‘লাইনম্যান’। যারা রাস্তায় পুলিশ, বিএসএফ থাকে কি না, তা জেনে কারবারিকে রিপোর্ট করে।

শেষ আপডেট: ০৫ অগস্ট ২০১৬ ০১:১৮
নদী দিয়ে গরু পাচার।

নদী দিয়ে গরু পাচার।

ডাঙ্গোয়াল, লাইনম্যান

গরু সীমান্তের দিকে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে দু’ধরনের লোককে কাজে নামানো হয়। একজন ‘ডাঙ্গোয়াল’। এরা গরুর সঙ্গেই থাকে। আরেকজন ‘লাইনম্যান’। যারা রাস্তায় পুলিশ, বিএসএফ থাকে কি না, তা জেনে কারবারিকে রিপোর্ট করে। এরা গরু পিছু দু’হাজার টাকা করে পায়। কোচবিহারের পুলিশ সুপার সুনীল যাদব জানান, সম্প্রতি বেশ কিছু গরু অবৈধ ভাবে নিয়ে যাওয়ার পথে আটক করেন তাঁরা। দু’জনকে গ্রেফতার করা হয়। পুলিশ তাদের জেরা করে নানা তথ্য পেয়েছে।

ভুয়ো কাগজ

ফালাকাটা-ধূপগুড়ি সড়ক দিয়ে প্রতি রাতে ছোট ট্রাকে (পিক-আপ ভ্যান) ১২-১৫টি, বড় ট্রাকে ২৫-৩০টি গরু গাদাগাদি ভাবে ভর্তি করে দিনহাটা, সিতাই, শীতলখুচির বাংলাদেশ সীমান্তে নিয়ে যাওয়া হয় বলে অভিযোগ করেন পুলিশেরই একটা অংশ। ভোর হলেই কোনও কোনও ট্রাক ভর্তি গরু ময়নাগুড়ি, ধূপগুড়ি সড়কের কোনও কোনও ধাবার পিছনে গোপন জায়গায় নামিয়ে খড়-বিচালি খাওয়ানো হয়। স্থানীয় কোন বাজারে গিয়ে গরু বিক্রির হাট থেকে রাজস্ব আদায়কারিদের মোটা টাকার বিনিময়ে গরু কেনার ভুয়ো কাগজপত্র তৈরি করে নেওয়া হয়। এই ব্যবস্থা চলছে তা ময়নাগুড়ি, ধূপগুড়ি, ফালাকাটার পুলিশ জেনেশুনেও চুপ করে থাকে।

পুলিশ অভিযুক্ত

উৎসব অনুষ্ঠানের জন্য কোনও ক্লাব গরু-ভর্তি ট্রাক আটক করলে ১০-১৫ মিনিটের মধ্যে পুলিশ চলে আসে। তারপরে যারা গাড়ি থামিয়েছে, তাদের লাঠি মেরে হঠিয়ে দেয়। যারা চাঁদা তুলছিল, তাদের অনেক সময় গ্রেফতারও করা হয়। বাসিন্দাদের কথায়, রাস্তায় গা়ড়ি থামিয়ে চাঁদা তোলা উচিত নয়। কিন্তু গরু ভর্তি ট্রাকের ক্ষেত্রে পুলিশের তৎপরতা একটু বেশি। সেটা চোখে লাগে।

দাম বেশ চড়া

দিনহাটার গীতালদহ, শুকারুরকুঠি, নাজিরহাট, সিতাই থেকে শুরু করে শীতলখুচি, মেখলিগঞ্জের সীমান্ত দিয়ে দিনের বেলায় রাস্তা দিয়ে শয়ে শয়ে গরু নিয়ে যাওয়া হয় সীমান্তের পথে। ট্রাকে চাপিয়ে ত্রিপল দিয়ে ঢেকেও গরু নিয়ে যাওয়া হয়। রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ থেকে বেশিরভাগ গরু নিয়ে আসা হয়। ওই গরুগুলি দাম অনেক বেশি। এক একটির দাম ভারতীয় টাকায় ২৫ হাজার টাকা থেকে শুরু করে ৫০ হাজার পর্যন্ত।

বর্ষায় সুবিধা

এখন বর্ষা। নদীগুলিতে জল বেড়েছে। ধরলা, কালজানির মতো নদী টপকে সহজেই সীমান্ত পার যাওয়া যায়। কাঠের বড় কাটাতন কাঁটাতারের উপরে ফেলে হাত-পা বেঁধে গরু ওই পাটাতনের এক দিকে বসিয়ে দেওয়া হয়। আরেক দিক থেকে চাপ দিয়ে গরু ওপাশে নিয়ে যাওয়া হয়। অভিযোগ, মেখলিগঞ্জের তিন বিঘা করিডর দিয়েই গরু পাচার হয়। প্রথমে দহগ্রাম-অঙ্গারপোতায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে ছোট ছোট গাড়িতে পাচার করা হয়।

ঢিল ছুড়ে পাচার

নাজিরহাটের দীঘলটারি, ছোট গাড়োলঝোরার মতো সীমান্তে বিএসএফ কর্মীরা জানান, সন্ধ্যের পরেই ওই এলাকায় ও পারে শতাধিক পাচারকারী জড়ো হয়। এ পাশেও থাকে। দুই তরফ থেকেই বিএসএফ জওয়ানকে উদ্দেশ্যে করে ঢিল ছোড়া শুরু হয়। বিএসএফ তা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লে, ফাঁকতালে গরু পাচার হয়। বিএসএফের এক আধিকারিক অবশ্য বলেন, “আমরা সন্ধ্যের পর থেকে সতর্ক থাকি। লক্ষ্য থাকে যাতে একটিও গরু পাচার না হয়।”

কালভার্টে গরু

দক্ষিণ বেরুবাড়িতে রাতে একটা বা দু’টো গরু সীমান্তের কাছে নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। ওপারে সঙ্কেত চলে যায়। গরু পার হয়ে যায়। নজরদারি একটু ঢিলেঢালা হলেই পাল পাল গরু একবারে পাঠানো হয়। যেখানে কাঁটাতারের বেড়া আছে সেখানে জলনিকাশি কালভার্টের সহায়তা নেওয়া হয়। গরুকে গোল পাইপের কালভার্টের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। গলায় দড়ি বাঁধা থাকে। ওপারের লোকজন দড়ি ধরে টেনে নিয়ে নেয়।

মোবাইলে খবর

গরু পাচারের স্বর্গরাজ্য হলদিবাড়ির বেলতলি এলাকার তিস্তানদী। গরুর পিঠের উপর নম্বর লাগানো থাকে। চরের মধ্যে দিয়ে সীমান্তের কাছাকাছি নিয়ে গিয়ে জলের মধ্যে গরুদের নামিয়ে দেওয়া হয়। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে খবর আদানপ্রদান হয়। নম্বর দেখে ওপারের গরু শনাক্ত করে যার যার গরু সে সে নিয়ে নেয়। বিএসএফের কাছে স্পিডবোট, নাইটভিশন ক্যামেরা সব থাকা সত্ত্বেও পাঁচ কিমিলম্বা তিস্তার চরে নজর সব সময় কড়া থাকে না।

বোমা ফাটিয়ে

মালদহের হাটে গরু বিক্রি করা হবে বলে বিহার ও ঝাড়খণ্ড থেকে নদী ও সড়ক পথে নিয়ে আসা হয় গরু। সীমান্তের চার কিলোমিটার আগে একদল কারবারী গরু পৌঁছে দেয়। তাদের গরু প্রতি ৫০০ টাকা করে মজুরি দেওয়া হয়। আর যারা সীমান্ত পার করে, তারা প্রতি গরুতে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা করে পায়। জল সাঁতরে গরু পাচার করা হয়। বিএসএফ সূত্রে জানা গিয়েছে, পিছু নিলে জলের মধ্যেই বোমা ফাটায় পাচারকারীরা।

সিঁদ কেটে গরু চুরি

দরজায় সাটার লাগানো পাকা ঘরে গরু রেখে বাইরে মাটির দাওয়ায় শুয়ে রাত কাটান দক্ষিণ দিনাজপুরের কুমারগঞ্জ সীমান্তের আঙ্গিনা-বোরটের অধিকাংশ বাসিন্দা। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া ওই এলাকায় সিঁদ কেটে বাড়ির গরু চুরি করে ওপারে পাচারের ঘটনা রীতিমত দস্তুর। হাল-কৃষি কাজে যুক্ত গৃহস্তের বক্তব্য, নিজেরা যেমনই থাকি, পাচারকারীদের হাত থেকে তো গাই-গরু গুলিকে রক্ষা করতে হবে।

লেজ ধরে ভেসে ওপারে

হিলি সীমান্তের ভরা যমুনায় হিলি বাজার থেকে মাত্র এক কিলোমিটার নদী পথে গরুকে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। পাশেই বিএসএফ চৌকি এবং থানা। পাচারকারীরা গরুর ল্যাজ ধরে ভেসে থাকে। স্রোতের টানে নদীতে ভেসে গরু সমেত সোজা ওপারে। বছর দুয়েক আগে এমন পাচার রুখতে বিএসএফের এক জওয়ান মারা যান।

ভিআইপি গরু

দামি গাড়ির সিট তুলে দিয়ে ভেতরে গরু শুইয়ে হিলি, কুমারগঞ্জ, গঙ্গারামপুর, বালুরঘাট সীমান্তে পাচার চলে। কালো কাচের আড়ালে দেখা যায় না ভিতরে কী রয়েছে। সম্প্রতি বালুরঘাটের পতিরাম এলাকায় একটি ওই ছোট গাড়ি ধরে ভেতরে চার পাঁচটি গরু রাখা দেখে পুলিশ থ। এখন ট্রাক্টরে শুইয়ে খড়কুটো কাঠের খড়ি দিয়ে ঢেকে গরু পাচার চলছে। গত ৯ জুলাই রাতে হিলির চকগোপাল সীমান্তে বিএসএফ টাক্টর আটক করে ভেতর থেকে ৮টি গরু উদ্ধার করে। তার মধ্যে একটি গরু দমবন্ধ হয়ে মারা গিয়েছিল।

—নিজস্ব চিত্র।

smuggling cow technique
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy