বালুরঘাট হাইস্কুলের দেওয়ালে ফাটল দেখাচ্ছেন শিক্ষকেরা। —নিজস্ব চিত্র।
স্কুল থেকে আদালত, কম্পনের হাত থেকে রেহাই পায়নি কিছুই। আর তার জেরেই আতঙ্ক ছড়িয়েছে দক্ষিণ দিনাজপুরের একাধিক জায়াগায়। একদিকে শতবর্ষপ্রাচীন বালুরঘাট হাইস্কুলে ফাটলের জেরে ভয় পাচ্ছেন শিক্ষক ও ছাত্রেরা। আবার জেলারই বুনিয়াদপুরে গঙ্গারামপুর মহকুমা আদালতের এজলাসগুলিতে ঘরময় ফাটল দেখা দেওয়ায় তাঁরা সবসময় আতঙ্কে রয়েছেন বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা। উদ্বিগ্ন বিচারকেরাও হাইকোর্টের রেজিস্ট্রারকে গোটা বিষয়টি চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন।
গত ২৫ এপ্রিল ভুমিকম্পের পরই ওই মহকুমা আদালতের পুরো দোতলা ভবন জুড়েই দেওয়ালে ফাটলের সৃষ্টি হয়েছিল। তারপরে চলতি মাসের ১২ মে ফের ভূমিকম্পের জেরে আদালত ভবনের সব ঘরে ফাটল আরও বেড়ে যাওয়ায় আতঙ্কিত আইনজীবী থেকে ওই আদালতের ল ক্লার্কেরা। তাঁরা ওই বাড়ি ছেড়ে পুরো আদালতটি অন্যত্র স্থানান্তরের দাবিও তুলেছেন। এ দিন মহকুমা আদালতের ল ক্লার্ক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আবুজার রহমান অভিযোগ করেন, আদালতের বিচারকের তরফে ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষকে আশঙ্কার কথা জানালেও এখনও অবধি কোনও সাড়া না মেলায় আমরা পেন ডাউন কর্মসূচীর পথে যেতে বাধ্য হবো।
মহকুমা আদালতের বিচারক সাধন মণ্ডল অবশ্য পরিস্থিতির ভয়াবহতা আঁচ করে আদালত ভবন স্থানান্তরের জন্য আগেই জেলা জজকে চিঠি দিয়েছিলেন। গত মঙ্গলবার (১২মে) ভূমিকম্পের পরেই তিনি ফের হাইকোর্টের রেজিস্ট্রারকে চিঠি দেন বলে জানা গিয়েছে। সরকারি আইনজীবী চিরঞ্জীব মিত্র বলেন, ‘‘অ্যাডিশনাল সেশন ও দায়রা জজ বর্তমান আদালত ভবনের পরিস্থিতি উল্লেখ করে চিঠিতে জানিয়েছেন, পুরনো আমলের ওই দোতলা ভবনটি পিলার ছাড়া তৈরি। এর আগে জেলা জজকেও আশঙ্কার কথা জানিয়েছিলেন। ভূমিকম্পে সব ঘরে ফাটল দেখা দেওয়ায় বিপদের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। কোর্ট বিল্ডিং অন্যত্র স্থানান্তরের জন্যও রেজিস্ট্রারের কাছে আবেদন করা হয়েছে। চিরঞ্জীববাবুর কথায়, ‘‘বুনিয়াদপুরে নতুন মহকুমা আদালতের বাড়ি তৈরির উদ্যোগ চলছে। টেন্ডার প্রক্রিয়াও শেষ হয়েছে। তবে বর্তমান বাড়িটির জীর্ণ দশা ও ভূমিকম্পের জেরে ফেটে যাওয়ায় আতঙ্ক তৈরি হওয়া স্বাভাবিক।’’
এ দিন মহকুমা আদালতের অ্যাসিস্ট্যান্ট পাবলিক প্রসিকিউটার জনার্দন সিংহ বলেন, ‘‘আদালত ভবনের পশ্চিম দিকের অংশ বিপজ্জনক হয়ে রয়েছে। ঝুঁকি নিয়ে সকলে আদালতের কাজ করলেও প্রত্যেকে ভয়ে রয়েছেন। এই বুঝি গোটা বাড়িটা হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়বে।’’ আইনজীবী অভীক সিংহের কথায়, ‘‘১৯৯৮ সাল থেকে বুনিয়াদপুরের ওই পুরনো জীর্ণ দোতালা বাড়ি ভাড়া নিয়ে আদালত চলছে। ছোট ঘরগুলিতে বসানো এজলাসে জায়গা সঙ্কুলান হয়না। তার উপর পর পর ভুমিকম্পের ধাক্কায় গোটা ভবনটির বিভিন্ন অংশে ফাটল দেখে বিচারপ্রার্থীদের মধ্যেও আতঙ্ক ছড়িয়েছে।’’ পরিস্থিতি যে দিকে যাচ্ছে তাতে যে কোনওদিন আদালতের কাজকর্ম বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলে অধিকাংশ আইনজীবী আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। এ দিন হরিরামপুরের নরদাস এলাকা থেকে মামলা শুনানিতে বুনিয়াদপুরে মহকুমা আদালতে উপস্থিত নজরুল ইসলাম, গুরুদেব নুনিয়া, বংশীহারির জাকির হোসেনরা সকলেই বলেন, ‘‘এজলাসের ঘরে ঢুকতে ভয় করে। আইনজীবীরা জানান, উপায় না দেখে হাইকোর্টের রেজিস্ট্রারকে মহকুমা বিচারক পরিস্থিতির কথা জানাতে বাধ্য হয়েছেন।
আতঙ্কের একই ছবি জেলা সদরেও। ভূমিকম্পে শতবর্ষ পেরিয়ে আসা দক্ষিণ দিনাজপুরের বালুরঘাট হাইস্কুল ভবনের একাংশে ফাটল দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে দোতলায় ভূগোলের প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসরুম এবং একাদশ শ্রেণীর ক্লাসরুমের পরিস্থিতি ভয়াবহ বলে দাবি একাংশ শিক্ষক-ছাত্রদের। আতঙ্কে ওই দুটি ঘরে পঠনপাঠন বন্ধ করে তালা দিয়ে রাখা হয়েছে। গত মঙ্গলবারের ভূমিকম্পে ক্ষতি হয়েছে বেশি। প্রধান শিক্ষক নারায়ণ কুণ্ডু জানিয়েছেন, ওই দুটি ঘর ছাড়াও নীচতলার কমনরুমের কাছে দেওয়ালে ফাটল দেখা দিয়েছে। ছাদের একটি অংশের বিম বসে গিয়েছে। বৃহস্পতিবার পরিস্থিতির কথা জেলা স্কুল পরিদর্শককে জানানো হয়েছে। স্কুলের পরিচালন কমিটির সভাপতি শুখেন্দু চট্টোপাধ্যায় বলেন, গত মে মাসে পর পর ভুমিকম্পে ঘরগুলিতে ফাটল দেখা দিয়েছিল। কিন্তু গত মঙ্গলবারের ভূমিকম্পের জেরে ঘর দুটির ছাদের কোন এবং বাইরের বারান্দার ওপরের অংশ বরাবর ফেটে পলেস্তারা খসে পড়েছে। ওই দুটি শ্রেণীকক্ষকে বিপজ্জনক বলে বন্ধ রেখে ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।
১৯০৭ সালে স্থাপিত বালুরঘাট হাইস্কুলের সেই বিট্রিশ আমলের কড়িবরগা ও চুন সুরকি ও চিটাগুড় দিয়ে তৈরি স্কুলের প্রধান শিক্ষক এবং টিচার্সরুমের উঁচু ভবনটি পর পর ভুমিকম্পেও কোনও ক্ষতি করতে পারেনি। এ দিন স্কুলে গিয়ে দেখা গিয়েছে, বহু ইতিহাসের সাক্ষী ওই পুরনো ভবনটির গায়ে নেই কোনও আঁচড়ের দাগ। কিন্তু পুরনো ভবনের সঙ্গে জোড়া দিয়ে গত ২০০২ সালে তৈরি দোতলার ওই অংশটিতে ব্যাপক ফাটল ধরে পলেস্তারা মেঝেতে খসে পড়ে আছে। শতবর্ষের ঐতিহ্যশালী জেলা স্কুলের ওই পরিস্থিতিতে আতঙ্কিত অভিভাবকদের একাংশ ওই ঘটনায় তদন্তের দাবি তুলেছেন। তাঁদের অভিযোগ, ওই ভবন তৈরিতে নিম্নমানের কাজ হয়েছে কি না, তার তদন্ত হওয়া উচিত। প্রধানশিক্ষক নারায়ণবাবু বলেন, ‘‘আমি স্কুলে যোগ দেওয়ার আগেই ওই অংশটি তৈরি হয়েছে। ইঞ্জিনিয়ররা বিষয়টি খতিয়ে দেখছেন।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy