তছনছ হয়ে পড়ে রয়েছে রামরতনবাবুর ঘর। তবে নিছক ডাকাতির জন্য খুন হয়নি বলেই অনুমান পুলিশের। নিজস্ব চিত্র।
একই বাড়িতে তিন জনকে খুনের খবর ছড়িয়ে পড়তেই শুক্রবার সকাল থেকে ইংরেজবাজারের বাতাস কান্নায়, রাগে ভারী হয়ে উঠতে থাকে।
ইটভাটার শ্রমিক রঘু সাহার কাছ থেকে খবর পেয়ে প্রথমেই ছুটে যান রামরতন অগ্রবালের দুই ভাই রামকৃষ্ণ ও রামলক্ষ্মণ অগ্রবাল। তাঁরা গিয়ে দেখেন, রামরতনবাবুর দেহ পড়ে রয়েছে বাড়ির গ্যারাজে। কিছু দূরে পরিচারক গণেশ রামের নিথর শরীর। দোতলায় পাওয়া যায় রামরতনবাবুর স্ত্রী মঞ্জুবাবুর দেহ। ধারালো অস্ত্রের আঘাতে তিন জনের ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত দেহ দেখতে পেয়ে কেঁদে ফেলেন রামকৃষ্ণ ও রামলক্ষ্মণবাবু। খবর পেয়ে একে একে আসতে শুরু করেন তাঁদের আত্মীয়স্বজনেরা। সন্ধের পরে বাড়িতে ফেরেন রামরতনবাবুর মেয়েরা। তাঁর বড় মেয়ে শ্বেতা কেডিয়া বলেন, ‘‘ভাবতেই পারছি না যে বাবা-মা নেই। কারা, কী কারণে বাবা-মাকে নৃসংশভাবে খুন করল জানি না। আমি দোষীদের কঠোর শাস্তি চাই।’’ ছোট মেয়ে নয়না বলেন, ‘‘বাবা-মাকে হারিয়ে আমি একেবারেই একা হয়ে গেলাম। যারাই খুন করুক না কেন, নিষ্ঠুরদের শাস্তি চাই।’’ রামকৃষ্ণবাবু বলেন, ‘‘পাশের বাড়িতেই থাকি। অথচ দাদা-বৌদিকে কেউ বা কারা খুন করে চলে গেল, টেরই পেলাম না। আমরা কিছুই করতে পারলাম না।’’
রামরতনবাবুকে কারা কেন খুন করেছে, তা এখনও পরিষ্কার নয়। পুলিশ তদন্ত শুরু করেছে। পুলিশের দাবি, কিছু সূত্রও তারা হাতে পেয়েছে। প্রাথমিক ভাবে অনুমান করা হচ্ছে, ব্যবসায়িক গণ্ডগোলের কারণেই খুন করা হয়েছে রামরতনবাবুকে। কিন্তু সেই সঙ্গে কেন তাঁর স্ত্রী ও পরিচারককেও খুন করা হল, তা নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে।
খুনের ঘটনায় এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে ব্যাপক আতঙ্ক ছড়িয়েছে। বিশেষ করে প্রতিবেশীরা প্রচন্ড আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। তাঁরা বলছেন, গভীর রাতে বাড়িতে ঢুকে দুষ্কৃতীরা যে ভাবে তিন জনকে খুন করে বেরিয়ে গিয়েছে, তা ভাবাই যাচ্ছে না। পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ তুলেছেন তাঁরা।
এই ঘটনায় ব্যবসায়ী মহলেও আতঙ্ক ছড়ানোর পাশাপাশি ব্যাপক ক্ষোভ ছড়িয়েছে। সেই ক্ষোভের জেরে এদিন সকাল সাড়ে নটা থেকে ব্যবসায়ীরা বিবেকানন্দ পল্লি সংলগ্ল ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক অবরোধ করেন। প্রায় এক ঘন্টা অবরোধ চলে। ঘটনাস্থলে পুলিশ সুপারকে ঘিরে বিক্ষোভও দেখান তাঁরা। পরে মিছিল করে গিয়ে পুলিশ সুপারের কাছে স্মারকলিপিও দেওয়া হয়। দুষ্কৃতীদের গ্রেফতারের দাবিতে পুলিশকে ৭২ ঘন্টা সময় বেঁধে দেন তাঁরা। পাশাপাশি এ দিন দুপুর থেকে জেলা সদরে ৪৮ ঘন্টা ব্যবসা বন্ধের ডাক দেওয়া হয়েছে। মাইকে সে কথা ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে এ দিন দুপুর থেকেই শহরে দোকানপাট বন্ধ হতে শুরু করে। আচমকা দোকানপাট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কেনাকাটা করতে আসা মানুষজন বিপাকে পড়েন। তাঁরা প্রশ্ন তুলেছেন, তিন জনকে খুনের ঘটনা সত্যিই মর্মান্তিক, কিন্তু তাই বলে ব্যবসা বন্ধ করে কী সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হবে?
এ দিকে মালদহ মার্চেন্টস চেম্বার অফ কমার্সের সম্পাদক উজ্জ্বল সাহা বলেন, ‘‘এই জেলায় একের পর এক ব্যবসায়ী খুন হচ্ছেন। চুরি-ডাকাতিও হচ্ছে ব্যবসায়ীদেরই বাড়ি ও দোকানে। অথচ পুলিশি কিছু করছে না। কোনও ঘটনার কিনারা হচ্ছে না। ব্যবসায়ীদের কোনও নিরাপত্তা নেই। বৃহস্পতিবার রাতে এই ব্যবসায়ী পরিবারের তিন জনকে খুন করা হয়েছে, এরপরে আমরা চুপ করে থাকতে পারি না। দুষ্কৃতীদের গ্রেফতারের দাবিতে আরও বড় আন্দোলন করা হবে।’’
রামরতনবাবুর বাড়ির গাঁ ঘেঁষেই বাড়ি নীলমাধব ও শর্মিষ্ঠা নন্দীর। শর্মিষ্ঠাদেবী বলেন, ‘‘বাড়িতে আমি ও স্বামী দু’জনে থাকি, কী ভাবে যে রাত কাটাব, তা ভাবতেই পারছি না।’’ তিনি জানান, পাশের বাড়িতে এমন ঘটনা ঘটলেও তিনি বা তাঁর স্বামী কিছুই টের পাননি। আর তাতেই আতঙ্ক আরও গ্রাস করেছে। আরেক প্রতিবেশী ষাটোর্ধ্ব মীনা কর্মকার বলেন, ‘‘আমাদের পাড়ায় আগে কখনও এমন ঘটনা ঘটেনি। বাড়ির ভিতরে যে ভাবে তিন জনকে খুন করা হয়েছে, তাতে ভয় পাচ্ছি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy