Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
এখনও ধরা পড়েনি দিলীপ

বন্ধ হোম, বাড়ি ফেরানো হচ্ছে আবাসিকদের

দুঃস্থ বালিকা ও কিশোরীদের হোম থেকে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়ার কাজ শুরু করে দিল দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা প্রশাসন। রবিবার হিলি থানার তিওড় এলাকায় ধীরেন মহন্ত শিশু নিকেতন নামে ওই হোম থেকে গরিব বাবা মায়ের হাত ধরে চোখের জলে বাড়ির দিকে পা বাড়াল হোমের আবাসিক খুদে বালিকা ও কিশোরীরা।

হোম থেকে বাড়ির পথে আবাসিকরা। —নিজস্ব চিত্র।

হোম থেকে বাড়ির পথে আবাসিকরা। —নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
তিওড় শেষ আপডেট: ১০ অগস্ট ২০১৫ ০৩:০২
Share: Save:

দুঃস্থ বালিকা ও কিশোরীদের হোম থেকে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়ার কাজ শুরু করে দিল দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা প্রশাসন। রবিবার হিলি থানার তিওড় এলাকায় ধীরেন মহন্ত শিশু নিকেতন নামে ওই হোম থেকে গরিব বাবা মায়ের হাত ধরে চোখের জলে বাড়ির দিকে পা বাড়াল হোমের আবাসিক খুদে বালিকা ও কিশোরীরা। মাঝপথে মেয়েদের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাঁরা অথৈ জলে পড়ে গেলেন বলে হতাশা গোপন করেননি হতদরিদ্র অভিভাবকেরাও। এ ব্যাপারে চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটির (সিডব্লিউসি) ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। সিডব্লিউসি-র চেয়ারম্যান সঞ্জীব মিত্রের দাবি, ‘‘হোম বন্ধের বিষয়ে আমরা কিছু জানি না। এটা সম্পূর্ণ ভাবে প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত।’’

জেলাশাসক তাপস চৌধুরী বলেন, সরকারের নির্দেশে হোমটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এদিন থেকে আবাসিক ৮৬ জন বালিকা ও কিশোরীকে তাদের অভিভাবকের হাতে তুলে দেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে। বাকি ৬ জন কিশোরী হোম কর্ণধার দিলীপ মহন্তর বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগের মামলার যুক্ত বলে, তাদের অন্য হোমে রাখা হয়েছে। অনেক অভিভাবকের কাছে খবর পৌঁছয়নি। ফলে ওই প্রক্রিয়া সোমবারেও চলবে। তারপর হোমটি পুরো সিল করে দেওয়া হবে।

এ দিন বেলা ১২টা থেকে এলাকার পঞ্চায়েত প্রধান ও সদস্যদের শনাক্তকরণের মধ্যে দিয়ে হোমের মোট ৮৬ জন আবাসিক মেয়েকে তাদের বাবা মা ও আত্মীয়ের হাতে তুলে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। তুলে রাখা হয় প্রত্যেকের ছবি। উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত জেলাশাসক সজলকান্তি টিকাদার, হিলির বিডিও মথিয়াস লেপচা, চাইল্ড প্রোটেকশন অফিসার জয়িতা মুখোপাধ্যায়, বালুরঘাট পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি প্রবীর রায় এবং সমাজকল্যাণ ও চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটির চেয়ারম্যান সঞ্জীববাবু সহ হিলি থানার পুলিশ অফিসার এবং মহিলা পুলিশ। ছিলেন ওই হোমের এনজিও-র সদস্যরা। এক সদস্যের বক্তব্য, ‘‘১১ জনের হোম পরিচালন কমিটির মধ্যে আমরা থাকলেও দিলীপ মহন্তই ছিলেন সব।’’ কেবল বিশেষ অনুষ্ঠানের দিনই তাঁরা হোমে আসতেন বলে দাবি করেছেন।

গত সোমবার হোমের কর্ণধার দিলীপের কুকীর্তির অভিযোগ সামনে আসার পরে সাত দিনের মাথায় হোমটি সিল করে আবাসিকদের বাড়ি পাঠিয়ে দিতে প্রশাসন যতটা সক্রিয়, অভিযুক্ত দিলীপকে ধরার ক্ষেত্রে তৎপরতার ক্ষেত্রে ততটাই নিস্ক্রিয় বলে অভিযোগ উঠছে। সাত দিন কেটে গেলেও দিলীপকে পুলিশ কেন ধরতে পারল না, তা নিয়ে আলোড়ন চলছে। জেলা কংগ্রেস সভাপতি নীলাঞ্জন রায়ের অভিযোগ, ‘‘প্রশাসন তড়িঘড়ি হোমটি বন্ধ করে দুঃস্থ পরিবারের আবাসিক মেয়েদের অথৈ জলে ফেলে দিল। কুকীর্তির নায়ককে ধরার ক্ষেত্রে ওই সক্রিয়তা নেই কেন? এ নিয়ে আমরা আন্দোলনে নামব।’’

একাধিক অভিভাবক জানিয়েছেন, হোম থেকে বেরিয়ে যেতে হওয়ায় ওই কিশোরীদের ভবিষ্যতে লেখাপড়া থমকে যেতে পারে। বালিকা ও কিশোরী দুই মেয়েকে হোম থেকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় এক প্রতিবন্ধী বাবার কথায়, ‘‘দুর্ঘটনায় এক পা নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর কোনও কাজ করতে পারি না।’’ বাদ্যযন্ত্রে চামড়া লাগানোর কাজ করে স্ত্রীকে নিয়ে তাঁর অভাবের সংসার। তিনি বলেন, ‘‘এখন দুই নাবালক মেয়ের ভরণপোষণ ও লেখাপড়া চালানোর মতো আর্থিক সামর্থ্য নেই। কী হবে বুঝতে পারছি না।’’

হিলি এলাকার সপ্তম শ্রেণীর এক কিশোরী সকাল থেকে কেঁদেই চলেছে। তার বাবা ও মা কয়েকবছর আগে ভিন রাজ্যে শ্রমিকের কাজে গিয়ে ফেরেননি। হোমের দায়িত্বপ্রাপ্ত সুপার ভক্তি সরকার লাহা বলেন, ‘‘আত্মীয় বলতে এক ঠাকুমা। যিনি ভিক্ষে করে দিন গুজরান করেন।’’ ওই কিশোরীর মতো আরও কয়েকজনের ভবিষ্যৎ অথৈ জলে, তা নিয়ে ভক্তিদেবীও এদিন চোখের জল আটকে রাখতে পারেননি। তিনি বলেন, ‘‘বাড়ি ফিরে যাওয়ার কথা শুনে সকাল থেকে ঘরে বসে মেয়েরা কেঁদে চলেছে। ওদের সান্ত্বনা দেওয়ার মতো আমার কাছে কোনও উপায় নেই।’’

হোমটি বন্ধ করে দেওয়ার প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত সুপার ভক্তিদেবী। এদিন বালুরঘাট, হিলি এবং কুমারগঞ্জ এলাকার মোট ৫১ জন আবাসিক কিশোরী ও বালিকাকে তাদের বাবা ও মায়ের হাতে তুলে দেওয়া হয়। হোম থেকে মেয়েদের নিয়ে অভিভাবকদের বাড়ি পৌঁছনোর সুবিধার জন্য ব্লক প্রশাসন থেকে একাধিক গাড়ির ব্যবস্থাও করা হয়েছিল। কিন্তু গাড়ি চড়ে বাড়ি ফেরার আনন্দ কিশোরীদের কাছে বিষণ্ণতায় ঢেকে গিয়েছে।

চোখ ভেজা থমথমে পরিবেশে গোটা হোমের আবাসিক কচিকাঁচাদের মধ্যে যেন শোকের আবহ। হিলির বিডিও মথিয়াসবাবু বলেন, ‘‘এদিন ৫১ জন আবাসিককে তাদের বাবা মায়ের হাতে তুলে দেওয়া হয়। বাকি ৩৫ জনকে আজ সোমবার বাড়িতে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হবে।’’

জেলাশাসক তাপসবাবু বলেন, ‘‘এই হোমের আবাসিক বালিকা ও কিশোরীদের অন্য হোমে রাখার মতো পরিকাঠামো নেই। তবে এদের মধ্যে যারা অনাথ, তাদের জন্য আমরা ভবিষ্যতে ভাবব। যাদের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হল, তাদের নিজ নিজ এলাকার স্কুলগুলিতে ভর্তি করিয়ে নেওয়ার জন্য নির্দেশ জারি করেছি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE