আগে কোনও দিন যাইনি। অনেক গল্প শুনেছি। সেই সব গল্পের অনেকগুলিতেই ছিল ভয়ের গন্ধ। তাই ১৬ এপ্রিল সকালে যখন এসএমএসটা এল নির্বাচন কমিশন থেকে, রক্তচাপ বাড়তে শুরু করেছিল। কপাল গুনেই হোক বা সাত জন্মের পুণ্যের ফলেই, শেষ পর্যন্ত গোলমাল কিছু ঘটেনি। তবে যে অভিজ্ঞতাটা হয়েছে, তাও কম দুর্বিষহ নয়।
এসএমএসে লেখা ছিল, বৈষ্ণবনগর বিধানসভা কেন্দ্রের সোবরাতি টোলা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ১৩৩ নম্বর বুথে যেতে হবে আমায়। সেই বুথের প্রিসাইডিং অফিসার করা হয়েছে আমাকে। একটা চাপা উত্তেজনা, উদ্বেগও বলা যায়, কাজ করছিল আমার। শুনেছি ওই সব ভোটকেন্দ্রে উত্তেজনা থাকে। এই ব্যাপারে চেনা-পরিচিত বন্ধুবান্ধবদের কাছে খোঁজ নিতে শুরু করলাম। তার পর ঘাঁটলাম ইন্টারনেট।
তবে কোনও লাভ বিশেষ হল না। আমার বুথে মোট ভোটার ছিল ১৩৩৭ জন। মনের মধ্যে একটি ভয় নিয়ে গেলাম ডিসিআরসি সেন্টারে। এখান থেকেই ভোটের যাবতীয় কাগজপত্র নিতে হয়। আবার ভোট শেষে সব কিছু জমাও দিতে হয়। সব কিছু দেখে বুঝে নিতে আড়াইটে বেজে গেল। তার পর আমি আর আমার চার সহকর্মী মিলে গেলাম গাড়ির খোঁজে। তাতে চেপেই যেতে হবে ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে।
মাথার উপর সূর্য যেন জ্বলছেন। এই অবস্থায় যে গাড়িটি আমাদের জন্য রাখা ছিল, তা দেখে মাথা ঘুরে গেল। সেটি একটি ম্যাটাডর। এই কাঠফাটা রোদে হুডবিহীন একটা গাড়িতে চেপে কী ভাবে এতটা পথ যাব, ভাবতেই পারছি না তখন।
বিভিন্ন জায়গায় চিৎকার করেও কিন্তু লাভ হল না। ওই গাড়িতেই চাপতে হল শেষ পর্যন্ত।
বুথে পৌঁছলাম সন্ধে সাড়ে ছ’টায়। সকালে খাওয়া দাওয়া করে ডিসিআরসি সেন্টারে গিয়েছিলাম। তার পরে পেটে বিশেষ কিছু পড়েনি। তাই বুথে যখন পৌঁছই, খিদেয় পেট জ্বলছে। খাওয়ার আগে স্নান করতে গিয়েছি। দেখি টিউবওয়েল দিয়ে কাদা জল বের হচ্ছে। এই জলে কী ভাবে স্নান করব, তা বুঝতে পারছি না। তখন এক গ্রামবাসী এসে বললেন, পাশের একটি বাড়িতে যেতে। চক্ষুলজ্জা ভুলে সেটাই করলাম। ওই বাড়ির লোকজন ভাল। তাঁরা সানন্দে রাজি। সেখানে স্নান সেরে এসে খোঁজ শুরু হল খাবারের। সারাদিন ধরে তো পেটে বিশেষ দানাপানি পড়েনি।
অবশেষে রাত ন’টায় এল ভাল আর ডাল। খিদের পেটে তাই সই। গপগপ খেয়ে শোওয়ার বন্দোবস্ত করতে গেলাম।
আমরা আসার আগেই কেন্দ্রীয় বাহিনী ও পুলিশ ওই বুথে পৌঁছে গিয়েছে। তাদের দেখে ভয় ভেঙেছে কিছুটা। কিন্তু শুতে গিয়ে দেখলাম, অন্য ভয়ের বিষয় রয়েছে সেখানে। খাট-টাট তো দূর, একটা চাটাই পর্যন্ত ছিল না। বন্ধুদের কাছ থেকে শোনা অভিজ্ঞতা কাজে লেগে গেল। আমি সঙ্গে মশারি আর চাদর সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম। চাদর বিছিয়ে মশারি টাঙিয়ে নিলাম। তার পর ঘুম।
পর দিন ১৭ এপ্রিল কাকভোরে ঘুম ভেঙে গেল। শৌচাগারে গিয়ে দেখি, জলের তেমন ব্যবস্থা নেই। ভরসা বলতে সেই পাশের বাড়ি। তাঁদের ওখানে গিয়ে স্নানটাও সেরে নিলাম। সঙ্গে নিয়ে যাওয়া ছাতুর ঘোল খেয়েই শুরু হল কাজ। তিন দলের এজেন্টদের নিয়ে ‘মক পোলিং’ করা হল। বুথের বাইরে তত ক্ষণে ভিড় জমাতে শুরু করে দিয়েছেন ভোটাররা।
শান্তিপূর্ণ ভাবেই মিটল ভোট। ভোটের হার ছিল ৮৭ শতাংশ। সমস্ত কাজ শেষ করতে সময় লেগেছিল রাত আটটা। এর পরে ডিসিআরসি সেন্টারে গিয়ে সব কিছু জমা দেওয়া হল। তখন ঘড়িতে বাজে রাত সাড়ে ১২টা। ইভিএম মেশিন জমা দিয়ে বের হওয়ার পরে হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।
(লেখক বৈষ্ণবনগর বিধানসভা কেন্দ্র, ১৩৩ নম্বর বুথে ছিলেন)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy