Advertisement
০৭ মে ২০২৪

স্বপ্ন ছোঁয়ার পরীক্ষায় ওরা

কারও বাড়িতে রোজ হাঁড়ি চাপে না। কেউ জন্ম থেকে চোখে দেখতে পান না। পরীক্ষার মুখে দুর্ঘটনায় পড়ে কাউকে থাকতে হচ্ছে হাসপাতালে। আবার কেউ মাত্র সাত দিন আগে মা হয়েছেন। কিন্তু স্বপ্ন যদি দেখতে হয়, কোনও প্রতিবন্ধকতাই আর বাধা হয়ে দাঁড়ায় না।

মগ্ন: রতুয়া হাসপাতালে পরীক্ষা দিচ্ছেন গৌরী। নিজস্ব চিত্র

মগ্ন: রতুয়া হাসপাতালে পরীক্ষা দিচ্ছেন গৌরী। নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ১৬ মার্চ ২০১৭ ০২:০৮
Share: Save:

কারও বাড়িতে রোজ হাঁড়ি চাপে না। কেউ জন্ম থেকে চোখে দেখতে পান না। পরীক্ষার মুখে দুর্ঘটনায় পড়ে কাউকে থাকতে হচ্ছে হাসপাতালে। আবার কেউ মাত্র সাত দিন আগে মা হয়েছেন। কিন্তু স্বপ্ন যদি দেখতে হয়, কোনও প্রতিবন্ধকতাই আর বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। উত্তরের এমন অনেকেই শরীর ও সংসারের নানা যন্ত্রণা উপেক্ষা করে বসলেন উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায়।

মসকেদুল, সুব্রত

দু’জনেরই বাবা রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। টানাটানির সংসার। দু’জনেই কোচবিহার টাউন হাইস্কুলের ছাত্র। সুব্রত কর পেস্টারঝাড় এলাকার বাসিন্দা। মসকেদুল ইসলামের বাড়ি দিনহাটার মাতালহাটে। সুব্রতর মা চকচকার একটি পাটের কারখানার শ্রমিক। বেশিরভাগ দিন স্কুলে যাওয়ার সময় বাড়িতে হাঁড়িই চাপে না। বুধবার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা শুরুর দিনেও বাড়িতে সকালে রান্না হয়নি। স্থানীয় এক টোটো চালক শেখর দত্ত সুব্রতকে নিজের বাড়িতে খাইয়ে পরীক্ষাকেন্দ্রে পৌঁছে দিয়েছেন। শেখরবাবু বলেন, “ছেলেটি এত কষ্ট করে পড়াশোনা করেছে দেখে ভাল লেগেছে। ভাড়া নিতে পারিনি। আর খাওয়াটুকু কী আর এমন।’’ মসকেদুল কোচবিহার ব্লাইন্ড স্কুলের আবাসনে থেকেই পরীক্ষাকেন্দ্রে যাতায়াত করছে। তার জন্যও টোটোর ব্যবস্থা ওই স্কুল শিক্ষকরা করেছেন। মসকেদুল মাধ্যমিকে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন।

সন্তান নিয়ে সাবানা

সাত দিনের ছেলেকে নিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিল ইংরেজবাজারের শোভানগর হাই স্কুলের ছাত্রী সাবানা বিবি। তাঁর পরীক্ষার সিট পড়েছে ইংরেজবাজারেরই ভর্তিটারি হাইস্কুলে। বছর খানেক আগে শোভানগরের নাথিনগর গ্রামের বাসিন্দা সাহেব শেখের সঙ্গে বিয়ে হয় সাবানার। সাত দিন আগে মিল্কি গ্রামীণ হাসপাতালে পুত্র সন্তানের জন্ম দেয় সাবানা। জেলা বিদ্যালয় পরিদর্শক তাপস কুমার দে বলেন, ‘‘ছাত্রীটি পরীক্ষা দেওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করলে আমরা তাঁকে সব রকম সহায়তা করেছি। আশা করছি আগামী দিনের পরীক্ষাগুলিও সুষ্ঠ ভাবে দিতে পারবে।’’

আরও পড়ুন: পাহারা কড়া, তবুও টুকলি

অসুস্থতা ও পথ দুর্ঘটনার জেরে হাসপাতালে বসেই পরীক্ষা দিলেন বেশ কয়েকজন পরীক্ষার্থী। মঙ্গলবার রাতে আচমকাই অসুস্থ হয়ে পড়েন রতুয়ার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী গৌরী মহালদার। রতুয়া ব্লক হাসপাতালের মেঝেতে বসেই পরীক্ষা দিয়েছেন। পরীক্ষা দিতে আসার পথে দুর্ঘটনায় জখম হন কালিয়াচকের ধনঞ্জয় মণ্ডল। তাঁর মাথা ফেটে যায়। সেই অবস্থাতেই পরীক্ষা দিতে চলে আসেন। রক্তক্ষরণ হতে থাকায় তাঁকে বাঙ্গিটোলা ব্লক হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। হাসপাতালেই তিনি পরীক্ষা দেন। পরীক্ষা চলাকালীন অসুস্থ হয়ে পড়েন পঞ্চানন্দপুর সুখিয়া হাই স্কুলের ছাত্রী মিলি মণ্ডল। তিনিও বাঙ্গিটোলা হাসপাতালের শয্যায় পরীক্ষা দেন। দুর্ঘটনায় জখম হওয়ায় পরীক্ষা দেওয়া হল না ধূপগুড়ির ছাত্র পীযূষকান্তি রায়ের৷ তাঁকে জলপাইগুড়ি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। জলপাইগুড়ি জেলা হাসপাতালে এ দিন তিন ছাত্রী পরীক্ষা দেন৷ দু’জন মঙ্গলবার থেকে হাসপাতালে ভর্তি৷ আর এক ছাত্রী এ দিন পরীক্ষা শুরুর পর পরীক্ষাকেন্দ্রেই অসুস্থ হয়ে পড়েন৷

হরেকৃষ্ণ-তনুশ্রী

কারও চোখে জন্ম থেকে অন্ধকার। কারও দৃষ্টি ঝাপসা। সেখান থেকেই ওঁরা শুরু করেছেন লড়াই। কেউ শুনে পড়া মুখস্থ করেছেন, কেউ বা ব্রেইল হরফ শিখেছেন দু’বছর ধরে। আর পাঁচ ছাত্র-ছাত্রীর মতো বুধবার তাঁরা পৌঁছলেন পরীক্ষাকেন্দ্রে। অনুলেখকের মাধ্যমে পরীক্ষায় খাতায় উত্তর লেখালেন তাঁরা। উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের উত্তরবঙ্গ আঞ্চলিক দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, উত্তরবঙ্গে এ বছর ৬১ জন প্রতিবন্ধী পরীক্ষা দিচ্ছেন। তার মধ্যে দৃষ্টিহীন প্রতিবন্ধী রয়েছে ১৬ জন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন হরেকৃষ্ণ শাহ, তনুশ্রী বিশ্বাস, তপন বিশ্বাস, ধনিরাম বর্মনরা। বাড়িতেও অভাব। তনুশ্রীর বাবা উত্তমবাবু গ্যারাজের কর্মী। দৃষ্টিহীনরা পরীক্ষায় অতিরিক্ত এক ঘণ্টা সময় পান। অনুলেখক নিয়ে তাঁদের পরীক্ষা দিতে হয়েছে। তবু বুধবার প্রথম দিনের পরীক্ষায় তাঁদের অধিকাংশরই অতিরিক্ত সময় প্রয়োজন হয়নি। উচ্চমাধ্যমিকের প্রথম দিন শিলিগুড়ি থেকে কোচবিহার সাক্ষী হয়ে রইল এই ৬১ পরীক্ষার্থীর লড়াইয়ের।

এবং প্রিয়া

কৃষ্ণমায়া স্কুলের ছাত্রী প্রিয়া তামাঙ্গ শারীরিক প্রতিবন্ধী। হাঁটাচলা করতে পারেন না। বাড়ি কদমতলায়। সেখান থেকে প্রতিদিন স্কুলে আসতেও পারেন না। গাড়িতে বা হুইল চেয়ারে তাঁকে যাতায়াত করতে হয়। বিবেকানন্দ স্কুলে এ দিন পরীক্ষা দিলেন তিনি। প্রিয়া শিক্ষিকা হতে চায়। সুব্রত, মসকেদুলও শিক্ষক হতে চায়। হরেকৃষ্ণর ইচ্ছে রেলে চাকরি করতে। ইঞ্জিন চালক হওয়ার ইচ্ছে রয়েছে তার। ইচ্ছে শক্তি আর স্বপ্নে ভর করেই লড়াই চালাচ্ছে উত্তরের ‘টিম ৬১’।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Higher Secondary Examination 2017 Poverty Problems
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE