কণাদির স্কুলে। ছবি তুলেছেন বিশ্বরূপ বসাক।
সকালের টিউশনি থেকে পড়াশোনার খরচ জোগাড় হয়ে যেত। বিকেলের টিউশনি থেকে চলত সংসার খরচ। বই কেনার সামর্থ্য ছিল না, ভরসা ছিল কলেজের লাইব্রেরিতে বসে লিখে আনা ‘নোট’। পুরোনো ক্যালেন্ডারের উল্টো দিক ছিল ড্রইং খাতা। পরিচিতদের বাড়ি থেকেও পুরোনো ক্যালেন্ডার নিয়ে আসতেন ছবি আঁকার জন্য। রং-তুলি ছিল না। পেন্সিল দিয়ে আঁকা ছবি। ‘কণাদি’র কথায়, “চার বোন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পোশাক পরে যে সময়টা কেটেছে, তখন রং-তুলি কেনা ছিল নিতান্তই বিলাসিতা।” তখন থেকে এখন।
চা বাগান-পাহাড় ঘেরা ডুয়ার্সের জনপদ মেটেলির স্কুল জীবন থেকে শিলিগুড়ির শ্রীমা সরণির বাড়ির স্কুল। ‘কণাদি’র লড়াই এখনও চলছে। শাড়ি-জামায় ফেব্রিকের নকশা, ছবি, সুতোর কাজ, পট আঁকা, হাতের কাজ, তত্ত্ব থেকে কনে সাজানো সবই শেখানো হয় তাঁর স্কুলে। সেই স্কুল থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে মৌসুমী, অন্যনা, সুদীপা-রাও এখন নিজেদের লক্ষ্যের সন্ধান পেয়েছেন।
ছবি আঁকা, হাতের কাজের জন্য চার বার রাজ্য এবং একবার জাতীয় স্তরের প্রতিযোগিতায় সেরার শিরোপা পেয়েছেন কণিকা ঘোষ। স্কুল শেষ করে যখন শিলিগুড়িতে চলে এলেন, তখন বাবা হৃদরোগে শয্যাশায়ী। সংসার চালাতে শিলিগুড়ি কলেজে পড়ার সময় থেকেই ছবি আঁকা এবং হাতের কাজের টিউশনি শুরু করেন। কয়েকজন শুভান্যুধায়ীর সাহায্যে ২০০৩ সালে শিলিগুড়ির তথ্যকেন্দ্রে তাঁর শিল্পকর্মের প্রদর্শনী করেছিলেন। তার পরে নিজের স্কুল তৈরি করেন। কণিকা থেকে হয়ে ওঠেন কণা-দি।
হায়দারপাড়ার শ্রীমা সরণির বাড়িতে শুরু হয় কণা-দির স্কুল ‘অমৃতা’র ক্লাস। যার টিউশন ফি মাসে ৮০ টাকা। রবিবার নারী দিবসের সকালে ছোট্ট স্কুলঘরে বসেই কণা-দি বললেন, “এখন আর অভাব নেই। হাতের কাজ বিক্রি করে কিছু আয় হয়। স্বামীও চাকরি করেন। তাই স্কুল থেকে আমার আয়ের প্রয়োজন নেই। কিন্তু আমার মতো মেয়েরা যাঁদের অভাবের প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়তে হয়, তাঁরা যাতে স্বনির্ভর হতে পারে সেটাই স্কুলে মূল্য লক্ষ্য।” কোনও ছাত্রী ফি জমা দিতে না পারলেও, তার নাম বকেয়া খাতায় ওঠে না।
শিলিগুড়ি ছাড়াও, জলপাইগুড়ি, রায়গঞ্জ, কালিয়াগঞ্জ, বালুরঘাট থেকেও ছাত্রীরা আসেন কণা-দির স্কুলে। বছর কয়েক আগে বাংলাদেশের থেকে একদল ছাত্রী এসে হাতের কাজের প্রশিক্ষণ নিয়ে গিয়েছে স্কুল থেকে। মৌসুমীর আঁকা শাড়ি পাড়ি দিয়েছে সুদুর মার্কিন মুলুকেও। ২০০১ সালে স্নাতক হওয়ার কিছু পরেই বাবার মৃত্যু ভাবিয়ে তুলেছিল মৌসুমীর পরিবারকে। সে সময় থেকেই স্বনির্ভরতার খোঁজ শুরু করেন শিলিগুড়ির হাকিমপাড়ার বাসিন্দা মৌসুমী রায়। ভরসা জোগায় ‘অমৃতা’। তার পরে এক দশকেরও বেশি সময় কেটে গিয়েছে। মা-ভাই-বোন এবং কাকিমাকে নিয়ে সংসারে মৌসুমী এখন অন্যতম উপার্জনকারী। মাস দুয়েক আগে এক পরিচিতের মাধ্যমে আমেরিকাতে গিয়েছে মৌসুমীর আঁকা ছবি সম্বলিত শাড়ি। শহরের একটি সাংস্কৃতিক সংস্থাতেও পোশাক এবং নানা উপকরণ তৈরি করে দেন মৌসুমী। তিনি বললেন, “আমেরিকা থেকে আরও বরাত আসবে।”
ডুয়ার্সের ওদলাবাড়ির অনন্যা বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। বাবা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মী। কলেজে পড়ার সময় থেকেই অনন্যা ভেবেছিল নিজের হাতখরচের বোঝা অবসরপ্রাপ্ত বাবা-র উপর চাপিয়ে দেবে না। আর তাই ওদলাবাড়ি থেকে সপ্তাহে ২ দিন ‘অমৃতা’য় যান অনন্যা। সেই সঙ্গে মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর পড়াও চালান। ওদলাবাড়িতে নিজেই আঁকা এবং হাতের কাজের স্কুল খুলেছেন।
অনন্যার কথায়, “কোনদিন নিজের খরচের জন্য বাড়িতে হাত পাততে হয়নি। পড়াশোনার খরচও কিছুটা জোগাড় করেছি। এতে মা-বাবাও গর্বিত।” আশির দশকের শেষে উচ্চ মাধ্যমিকের পরে আর পড়া সম্ভব হয়নি অর্পণা সেনের। ৩ বোন, ২ ভাই। সংসারের দায়িত্বও খানিকটা চলে এসেছিল। তখনই আঁকা এবং হাতের কাজের স্কুলে তালিম শুরু। নকশা করা শাড়ি, টেবিল ক্লথ, আয়নার ঢাকনা থেকে শুরু করে কাগজের নানা হাতের কাজে অর্পণা দেবী এখন নিজেই শিক্ষক। নিজেও বিভিন্ন সামগ্রী তৈরি করে বিক্রি করেন। দিদি বোনেদের বিয়ে হয়ে গেলেও, নিজে রং-তুলি নিয়েই রয়ে গিয়েছেন। দুঃস্থ পরিবারের মেয়েদের ডেকে নিয়ে আসেন নিজের স্কুলে। বললেন, “‘অমৃতা না থাকলে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর মানেটা বুঝতে পারতাম না। স্বনির্ভর হওয়াই জীবনের সবচেয়ে বড় সাফল্য। সেটাই সকলকে বলি।” ‘অমৃতা’র ক্লাসঘরে এমনই অসংখ্য মৌসুমী, অনন্যা, অর্পণাদের ভিড়। ইদানীং শিক্ষার্থীদের ভিড় বাড়ায় প্রশিক্ষণের জায়গা বড্ড কম মনে হয় অনেকেরই। তাতে কী! ছোট্ট ঘরে বসে শিখে-শিখিয়ে স্বনির্ভর হওয়াটা আকাশছোঁয়ার চেয়ে কম কিছু কি!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy