শিলিগুড়ি মোড়ে এটিএম রক্ষীহীন। মঙ্গলবার। ছবি: তরুণ দেবনাথ।
আর পাঁচটা পুরসভার তুলনায় রায়গঞ্জের পরিষেবার হাল যে ভাল সে কথা এলাকার বিরোধী দলের নেতারাও মানেন। কিন্তু, একটা ব্যাপারে শহরের অনেক মহলেরই কিন্তু উদ্বেগ রয়েছে। তা হল, আইনশৃঙ্খলা। বিহার লাগোয়া হওয়ায় রায়গঞ্জে ঢুকে দুষ্কর্ম ঘটিয়ে চলে যায় দুষ্কৃতীরা। তাতে স্থানীয় দুষ্কৃতীদেরও মদত থাকে বলে পুলিশের নজরে এসেছে। পুলিশ নজরদারি বাড়ানোর ব্যাপারে আশ্বাস দিলেও শহরবাসীদের সকলের ভয় কিন্তু কাটেনি। কারণ, রায়গঞ্জের বেশির ভাগ ব্যাঙ্কের এটিএম-এ সন্ধ্যের পরে লেনদেন করতে যেতে অনেকেই সাহস করেন না। শহরের একাধিক প্রবীণ বাসিন্দা জানান, অনেক এটিএম-এ নিরাপত্তা রক্ষী নেই। কয়েকটি জায়গায় নিরাপত্তারক্ষী থাকলেও ঝামেলা হওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
অবশ্য রায়গঞ্জে যে ফি মাসে ইতিউতি চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে সেটা পুলিশের নথিও বলছে। পুলিশ সূত্রের খবর, রায়গঞ্জ থানা এলাকায় ফি মাসে গড়ে ১০টি চুরি, ৪টি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। তোলা আদায়, বেআইনি আগ্নেয়াস্ত্রের কারবার, বেআইনি মদ ও নেশাজাতীয় সামগ্রীর ব্যবসাও চলছে বলে অভিযোগ। বাইক চুরির ঘটনাও কমছে না। শহর থেকে ফি বছর গড়ে ২০টিরও বেশি বাইক চুরি হয় বলে থানায় অভিযোগ পড়ে। পুলিশ অবশ্য বিষয়টি নিয়ে সতর্কও রয়েছে। গত ১২ জুলাই হেমতাবাদের দুধুন্ডা এলাকা থেকে চোরাই বাইকের কারবার করার অভিযোগে এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ধৃতের বাড়ি থেকে ২৫টি চোরাই বাইকও উদ্ধার হয়। ওই যুবককে জেরার সুবাদেই বাইক চুরি সহ রায়গঞ্জে নানা অসামাজিক কার্যকলাপে বিহারের দুষ্কৃতীদের জড়িত থাকার ব্যাপারে স্পষ্ট প্রমাণ পেয়েছে পুলিশ।
বিহার ও বাংলার দুষ্কৃতীদের মধ্যে গোলমালের ঘটনাও কম ঘটে না। দু-দলের গোলমালের জেরে খুন-পাল্টা খুনের ঘটনাও রায়গঞ্জ দেখেছে। পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ সালের নভেম্বর মাস থেকে এখনওপর্যন্ত রায়গঞ্জ থানা এলাকায় ২৫টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ব্যবসা সংক্রান্ত বিবাদ বা টাকা নিয়ে গোলমালের জেরে অনেকে খুন হন। বিহার থেকেই বেআইনি আগ্নেয়াস্ত্র শহরে ঢোকে বলে পুলিশের সন্দেহ। রায়গঞ্জে জাতীয় সড়ক সংলগ্ন একাধিক ধাবায় বেআইনি মদের কারবার চলছে বলে অভিযোগ।
খুনোখুনির ঘটনাও কম নেই। গত বছরের জানুয়ারি মাসে রায়গঞ্জ থানা এলাকায় দুই তৃণমূল কংগ্রেস নেতা সহ মোট ১০ জন খুন হন। ওই বছরের ১১ জানুয়ারি মাড়াইকুড়া এলাকায় দুই তৃণমূল নেতাকে কুপিয়ে ও গুলি করে খুন করে পালায় দুষ্কৃতীরা। পর দিন উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব নিহতদের বাড়িতে সমবেদনা জানাতে গিয়ে বাসিন্দাদের বিক্ষোভের মুখে পড়েন। বাসিন্দাদের অভিযোগ ছিল, পুলিশের নিষ্ক্রিয়তায় শহরে বেআইনি আগ্নেয়াস্ত্রের কারবার, খুন, ছিনতাই, তোলাবাজি সহ বিভিন্ন সমাজবিরোধী কার্যকলাপ বাড়ছে। তবে রায়গঞ্জের তুলসিতলা এলাকার বাসিন্দা পেশায় উত্তরবঙ্গ রাষ্ট্রীয় পরিবহণ নিগমের অবসরপ্রাপ্ত কর্মী পরিতোষ দেবনাথ বলেন, “আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আগের চেয়ে ভাল। তবে আরও ভাল না হলে বাসিন্দারা নিশ্চিন্তে চলাফেরা করতে পারবেন না।”
পুলিশ কী বলছে? পুলিশ অফিসার ও কর্মীদের একাংশের দাবি, পর্যাপ্ত অফিসার ও কর্মী নেই। সে জন্য আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক রাখার কাজে সমস্যা হয়। শুধু রায়গঞ্জ শহরের জনসংখ্যা ১ লক্ষ ৮২ হাজার জন। আইনশৃঙ্খলা সামাল দিতে রায়গঞ্জ থানায় আইসি, সাব ইন্সপেক্টর ও সহকারি সাব ইন্সপেক্টর মিলিয়ে রয়েছেন ২০ জন। কনস্টেবল রয়েছেন ২৬ জন। অনেক ক্ষেত্রেই সিভিক ভলান্টিয়ার্সদের উপরে নির্ভর করতে হল পুলিশকে। দুটি ব্যারাক থাকলেও তাতে সব পুলিশ কর্মীদের থাকার জায়গা হয় না। মহিলা কনস্টেবলদের থাকার জন্য থানায় কোনও ব্যারাক নেই। ফলে মহিলা কনস্টেবল সহ বহু পুলিশকর্মীকেই থানার বাইরে থাকতে হয়। ফলে আইনশৃঙ্খলার অবনতি হলে চটজলদি তাঁদের পাওয়া যায় না। থানায় চারটি পুলিশের গাড়ি থাকলেও তার মধ্যে তিনটি গাড়ি পুরনো হয়ে গিয়েছে। সেগুলি ঘন্টায় ৪০ কিলোমিটার গতিবেগের বেশি চলে না। ফলে তাড়াতাড়ি ঘটনাস্থলে যাওয়া বা তাড়া করে দুষ্কৃতীদের গ্রেফতার করতে গিয়েও পুলিশকে সমস্যায় পড়তে হয়।
কয়েকজন পুলিশকর্মী জানান, দুষ্কৃতীদের তাড়া করতে গিয়ে অনেক সময়েই তাদের গতিবেগের সঙ্গে পুলিশের গাড়ি পাল্লা দিতে পারে না। সেই সুযোগ দুষ্কৃতীরা বিহারে ঢুকে পড়ে বলে ওই পুলিশকর্মীদের কয়েকজনের দাবি। উত্তর দিনাজপুরের পুলিশ সুপার সৈয়দ ওয়াকার রেজা খুব বেশিদিন এলাকার দায়িত্ব নেননি। পুলিশ সুপার কোনও মন্তব্য করতে চাননি। তবে পুলিশ সূত্রের খবর, নবাগত পুলিশ সুপার রায়গঞ্জ শহরের চারদিকে টহলদারি বাড়ানোর উপরে নির্দেশ দিয়েছেন। পরিকাঠামোর ঘাটতি পূরণ করতে আরও গাড়ি, অফিসার-কর্মী বাড়ানোর প্রক্রিয়াও শুরু করেছেন তিনি। অন্তত, শাসক দল তৃণমূলের জেলার শীর্ষ নেতারা এমনই দাবি করেছেন।
(চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy