দৃষ্টিহীন পড়ুয়াদের অনুষ্ঠান। মঙ্গলবার শিলিগুড়িতে তোলা নিজস্ব চিত্র।
মস্তিষ্কে পক্ষাঘাতজনিত কারণে প্রতিবন্ধী পুজা পাল, শিখা রায়রা যখন প্রদীপ জ্বালিয়ে অন্য অতিথিদের সঙ্গে অনুষ্ঠানের সূচনা করলেন তখন হাততালি দিয়ে উঠলেন সকলে। এক পা কৃত্রিম হলেও মঞ্চে নাচ করলেন আমবাড়ি হাই স্কুলের ছাত্রী আলাই মণ্ডল। নাচ দেখালেন মাটিগাড়া বালিকা বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রী মানসিক প্রতিবন্ধী পিয়ালী বর্মন। এ বছর মাধ্যমিক দেবে ওই ছাত্রী। নাটক, মুখাভিনয় করলেন সুধা কুজুর, পূজা সরকার, তাহিদা বেগমদের মতো দৃষ্টিহীন এবং অন্যান্য প্রতিবন্ধীরা। মঙ্গলবার শিলিগুড়ির কাঞ্চনজঙ্ঘা স্টেডিয়ামের হলঘরে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের উদ্যোগে ওই অনুষ্ঠান হয়। স্কুল কলেজে সাধারণ ছেলেমেয়ে এবং প্রতিবন্ধীদের একযোগে সমন্বিত শিক্ষা ব্যবস্থার উপর জোর দিতেই এ দিনের অনুষ্ঠান।
প্রতিবন্ধী ছেলেমেয়েরাও জানান, তাঁরা কোনও অংশে কম নয়। কিন্তু তাদের সুযোগ সুবিধা অনেক ক্ষেত্রকেই দেওয়া হয় না। তবে পরিস্থিতি পরিবর্তন হচ্ছে। পুজা, পিয়ালীর মতো অনেক প্রতিবন্ধী ছেলেমেয়েরা আর পাঁচজন ছেলেমেয়েদের সঙ্গে স্কুলে পড়ছে। প্রেরণা তথা নর্থ বেঙ্গল কাউন্সিল ফর দ্যা ডিসেবলডের তরফে জানানো হয় প্রতিবন্ধীরা যাতে সাধারণ ছেলেমেয়েদের সঙ্গেই পড়াশোনা করতে পারে, কর্মক্ষেত্রে অংশ নিতে পারে সে জন্য এই প্রচেষ্টা। শিক্ষা দফতর এবং সরকারের সাহায্য নিয়েই সমন্বিত শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে জোর দিতে চাইছে তারা। এ দিন অনুষ্ঠানেও উপস্থিত ছিলেন শিলিগুড়ির সর্বশিক্ষা অভিযানে প্রকল্প অধিকর্তা প্রেমকুমার বরদেওয়া, প্রকল্প কো অর্ডিনেটর প্রদীপ অধিকারী। তাঁরাও বিষয়টি গুরুত্ব দিতে জোর দেন। প্রেমকুমারবাবু বলেন, “আমাদের সকলেরই কিছু না কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। তা উত্তীর্ণ হয়েই আমাদের এগোতে হয়। প্রতিবন্ধীদের ক্ষেত্রেও তাই। তাঁদেরকে এক সঙ্গে নিয়েই এগোতে হবে।”
অন্যতম উদ্যোক্তা প্রেরণা এডুকেশন সেন্টারের তরফে জানানো হয় বিশ্বে ১৮৯ টি দেশ এ ব্যাপারে প্রচার এবং জোর দিতে উদ্যোগী হয়েছে সিবিএম সংস্থা। এ দেশে ৭টি রাজ্যে আপাতত এই কর্মসূচি নেওয়া হচ্ছে। রাজ্যে চারটি জেলায় প্রাথমিক ভাবে ওই কর্মসূচি হবে। তার মধ্যে শিলিগুড়িতে প্রেরণা এডুকেশন সেন্টারের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে ওই কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। সংস্থার অন্যতম কর্মকর্তা রিতা সেনগুপ্ত বলেন, “সমাজিক ভাবে সমন্বিত শিক্ষা ব্যবস্থার উপর জোর দিতে হবে। স্কুলে যে শিক্ষিক-শিক্ষিকা অন্য পড়ুয়াদের পড়াচ্ছেন তাঁরাই প্রতিবন্ধীদের বোঝার মতো করে শেখাবেন। স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকা, প্রধানশিক্ষক এমনকী দারোয়ান সকলকেই এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। বাড়ির অভিভাকদের দেখতে হবে স্বাভাবিক সন্তানকে তাঁরা যে ভাবে বড় করতে সচেষ্ট হন, প্রতিবন্ধী ছেলেমেয়েদেরও একই ভাবে সাহায্য করতে হবে। বৈষম্য করলে চলবে না।” সরকারি ভাবে সমস্ত স্কুলগুলিতে সেই ব্যবস্থা কার্যকরি করতে ইতিমধ্যেই বলা হয়েছে। তবে অনেক ক্ষেত্রেই প্রচেষ্টার অভাব রয়েছে বলে অভিযোগ।
এ দিন অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া শাস্ত্রীনগরের বাসিন্দা সিধু মোহন্ত জানান, তাঁর দুই সন্তান। সুব্রত এবং পলাশ। সুব্রত মস্তিষ্কে পক্ষঘাতজনিত কারণে প্রতিবন্ধী। সুব্রত স্বাভাবিক। নর্থবেঙ্গল কাউন্সিল ফর দ্যা ডিসেবলডের সঙ্গে যোগাযোগ হয়ে তাঁরা সচেতন হয়েছেন। দুই সন্তানকেই সমানভাবে বড় করার দিকেই নজর দেন। ভানুনগরের বাসিন্দা স্বপ্না কুণ্ডু জানান, ১২ বছরের মেয়ে দীপা শারীরিক প্রতিবন্ধী। সকল ছেলেমেয়েদের সমান মনোভাব নিয়ে দেখতে অভিভাবকদের মধ্যে সচেতনতা প্রচারে তিনি নিজেও উদ্যোগী।
এ দিনের অনুষ্ঠানে নাটক করলেন সুধা কুজুর, রাজু রায়, কৃপা কুজুররা। নাটকের নাম ‘ইচ্ছে’। বাড়ি থেকে সামাজের নানাস্তরে তাদের বড় হওয়ার পথে যে বাধা তা নিয়েই নাটক লিখেছেন দৃষ্টিহীন ওই প্রতিবন্ধী ছেলেমেয়েরা। কৃপা, তাহিদা বেগমরাই জানালেন, “আমাদের ক্ষেত্রে এটা পারব না। ওঠা পারব না এমনটাই মনোভাব নিয়ে দেখে সমাজ। কিন্তু আমরা যে কোনও অংশে কম নই। সুযোগ সুবিধা পেলে অন্যদের মতো আমরাও সমস্ত কিছুই করতে পারি।” তাদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে একই সুরে সকলেই সে কথা তুলে ধরলেন নাটকের মধ্য দিয়ে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy