কাজ চলছে দিনহাটার একটি পাটের গুদামে। হিমাংশুরঞ্জন দেবের তোলা ছবি।
পরিকল্পনাহীনতায় ধুঁকছে দিনহাটার অর্থনীতিও। না হলে শুধু পাট আর তামাকের ব্যবসার ওপর নির্ভর করেই দিনহাটার আর্থিক ছবি অনেক অনেক বদলে যেতে পারত। কিন্তু এখন আগের সেই সোনালি দিন নেই। নেই বাইরের ব্যবসায়ীদের তেমন আনাগোনা। ফলে ব্যবসা নতুন দিশা পায়নি গতানুগতিক খাতে বইছে।
দিনহাটার পাট-তামাকের গুণগত মানের খ্যাতি দেশ জুড়ে। বিদেশের বাজারেও একসময় দেদার তামাক রফতানি হতো। দিনহাটার বাজার থেকেই ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, ফি বছর রথের দিন থেকে দক্ষিণবঙ্গের পাশাপাশি ওড়িশা, অসম, দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ থেকে ব্যবসায়ীরা দিনহাটায় ডেরা বাঁধতেন। বাড়ি ও গুদামঘর ভাড়া নিয়ে দুর্গাপুজো পর্যন্ত পাট কিনে মজুত করতেন। জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত তামাকের মূল বিকিকিনি চলত। বাইরের ব্যবসায়ীদের ভিড় থাকায় একটা অলিখিত প্রতিযোগিতা হতো। ফলে বাজার থাকত চড়া। যার সুফল পেতেন গোটা মহকুমার কৃষকেরা। স্বাভাবিকভাবেই দিনহাটা শহরের বাজারে জামাকাপড় থেকে হার্ডওয়্যার সামগ্রী বিক্রির হিড়িক ছিল। বিশেষ করে দুর্গাপুজো ও ঈদের মুখে জমে উঠত দিনহাটার বাজার। নব্বইয়ের দশকের শেষদিক থেকে অবশ্য বাজারে মন্দার সূত্রপাত।
বাজারে তামাকজাত পণ্য নিয়ে কড়াকড়ি শুরু হল। প্লাস্টিক ব্যাগের ব্যবহার বেড়ে যাওয়াও আরেকটি অন্যতম কারণ। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, এমনিতেই সীমান্ত এলাকায় পাট চাষ নিয়ে নিরাপত্তাজনিত কারণে বিএসএফের তরফে নানা সময়ে আপত্তি করা হয়। তার ওপর প্লাস্টিকের ব্যাগের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় একসময় দক্ষিণবঙ্গের পাটজাত কারখানাগুলি ধুঁকতে থাকে। বন্ধও হয়ে যায় বহু কারখানা। বাজারে পাট কেনার প্রতিযোগিতা কমে যায়।
কৃষকরা আগ্রহ হারানোয় কমে যায় পাট চাষের এলাকা। তামাকজাত সামগ্রী নিয়ে বিধিনিষেধের কড়াকড়ির সঙ্গে যুক্ত হয় আরেকটি সমস্যা। তা হল অসমের ব্যবসায়ীরা তামাক কেনা বন্ধ করে দেন। বংশানুক্রমিকভাবে তামাক চাষে অভ্যস্ত কৃষক পরিবারের অনেকেই বিকল্প চাষের ব্যাপারে সঠিক দিশা পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ।
এরই প্রভাব পড়েছে দিনহাটার বাজারে। দিনহাটা মহকুমা ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক রাণা গোস্বামী বলেন, “পাট ও তামাক দিনহাটার আদি ব্যবসা। ওই দুইয়ের ওপরেই দিনহাটার অর্থনীতির ভিত তৈরি হয়। সঠিক পরিকল্পনার অভাবে পাট, তামাক ব্যবসা শিকেয় ওঠার উপক্রম হওয়ায় সেই ভিত নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। প্লাস্টিকের ব্যবহার কমিয়ে অন্তত সরকারি প্রকল্পে চটের বস্তা, সামগ্রী বাধ্যতামূলক করা যেতে পারত। তামাক থেকে রঙ তৈরির মত শিল্প গড়ার কথাও ভাবা যেত। কিছুই কেউ ভাবেননি। তাই দিনহাটার সমস্যা মিটছে না।”
দিনহাটার ওই অর্থনীতিতে খানিকটা হলেও অবশ্য গীতালদহ ইমিগ্রেশন সেন্টারের ভূমিকা ছিল। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, ১৯৯৭ সাল থেকে বন্ধ হয়েছে ওই ইমিগ্রেশন সেন্টার। ফলে, দিনহাটা শহর হয়ে বাংলাদেশে পণ্য সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে রয়েছে। বাইরের ট্রাকের আনাগোনায় হোটেল থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী কেনাকাটার বাড়তি চাহিদার সুযোগ থাকত। সেটাও এখন অতীত যেমন ইতিহাসের পাতায় স্থান পেয়েছে দিনহাটা-লালমণিরহাট রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা।
দিনহাটার বাসিন্দা তথা ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সমম্বয় কমিটির সহকারি সম্পাদক দীপ্তিমান সেনগুপ্তের কথায়, “ইমিগ্রেশন সেন্টার, দিনহাটা-বাংলাদেশের লালমণিরহাট রেল যোগাযোগ চালু হলে অর্থনীতির বেহাল ছবিটা বদলাতে পারত। পাট, তামাকের ব্যবসার মন্দা সামলে দিনহাটাকে ঘুরে দাঁড় করাতেই হবে। বিকল্প কোন পথ দ্রুত কাজ করবে না, সেটা হলফ করে বলতে পারি।” যা মানছেন বাসিন্দারাও। এতসবের পরেও অবশ্য দিনহাটা শহরের চওড়াহাট বাজার পেরোতেই ভেসে আসে তামাকের গন্ধ, বাতাসে উড়ে বেড়ায় পাটের আঁশ। ওই গন্ধ আর আঁশের আশাতেই ফের চাঙা হওয়া অর্থনীতির স্বপ্ন দেখে গোটা দিনহাটা।
(চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy