যে সংস্থা থেকে মৃত উত্তম সাহার পরিবার গ্যাস নিতেন তার নথি। —নিজস্ব চিত্র।
রান্নার সময়ে আগুনে পুড়ে একই পরিবারের তিন জনের মৃত্যুর পাঁচদিনের মাথায় গ্যাস সিলিন্ডার সরবারহকারী সংস্থার হদিশ মিলল। মৃতদের পরিবার যে নাম বলেছিল, সেই সংস্থা প্রথমে অস্বীকার করলেও বুধবার তারা সুর পাল্টেছে। গত শুক্রবারের ঘটনার পরে এ দিন বুধবার গ্যাস সিলিন্ডার সরবারহের নথি খুঁজে প্রধাননগর থানায় জমা করেছেন মৃতদের পরিজনেরা। এর পরেই শিলিগুড়ির প্রধাননগরের গ্যাস সরবারহকারী সংস্থাটি নিজেদের সিলিন্ডার বলে স্বীকার করে নিয়েছে। যদিও, ঘটনার পরদিন থেকেই ওই সংস্থার অন্যতম কর্ণধার বাপি দাস বারবার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। বাপিবাবু কেন প্রথম থেকে বিষয়টি আড়ালের চেষ্টা করেন তা নিয়ে বাসিন্দাদের মধ্যে সন্দেহ ঘনীভূত হয়েছে। বাসিন্দাদের অনেকের সন্দেহ, সিলিন্ডার সরবারহের আগে যদি ভালভাবে পরীক্ষা করে নেওয়া হতো তবে দুর্ঘটনা এড়ানো যেত। ওই গাফিলতির অভিযোগ এড়াতেই প্রথমে সংস্থাটি তাদের দায় এড়ানোর চেষ্টা করে বলে কিছু বাসিন্দাদের সন্দেহ।
ঘটনা হল, গ্যাস সংযোগের নথি মিললেও, বুধবার রাত পর্যন্ত পুলিশের তরফে ওই সংস্থার অফিসে গিয়ে নথি খতিয়ে দেখা বা খোঁজখবর করা হয়নি বলে অভিযোগ। যে ব্যক্তির নামে থাকা সংযোগ থেকে মৃতদের পরিবার সিলিন্ডার পেত, সেই ব্যক্তিকে এ দিন দুপুরে মৃতের পরিজনরা প্রধাননগর থানায় নিয়ে যান। তাঁর বয়ান নথিবদ্ধ করানো হয়নি কেন তা নিয়েও ধন্দে রয়েছে মৃতের পরিবার। সে কারণেই বাসিন্দাদের একাংশের অভিযোগ, তিন জনের মৃত্যু হলেও, পুলিশ বিষয়টিকে ততটা গুরুত্ব দিতে চাইছে না। শিলিগুড়ির পুলিশ কমিশনার জগ মোহন এ দিন বলেন, “কীভাবে আগুন লাগল সে সম্পর্কে আমাকে অন্যরকম ব্যাখ্যা করা হয়েছিল। গ্যাস লিক ছিল কিনা, থাকলে কী করণীয় তা জানতে হবে। সরবাহকারী সংস্থার ভূমিকাও গুরুত্ব দিয়ে খতিয়ে দেখা হবে।”
গত শুক্রবার রাতে চম্পাসারির একটি দরমা-বেড়ার ঘরে আগুন লেগে উত্তম সাহা, তাঁর স্ত্রী এবং মেয়ে, তিন জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। পরিবার সূত্রের খবর, মৃত্যুর আগে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি থাকা অবস্থাতেই গ্যাস লিক থাকার কথা জানিয়ে প্রধাননগরের ওই সরবারহকারী সংস্থার নাম জানিয়েছিলেন উত্তমবাবু। ওই দরিদ্র পরিবারের নিজেদের নামে গ্যাসের সংযোগ না থাকলেও, উত্তমবাবুর ছেলে প্রথম বর্ষের ছাত্র বাবু জানন, পরিচিত নর্মদা বাগান এলাকার বাসিন্দা সাধন পালের নামে থাকা সংযোগ তাঁরা ব্যবহার করতেন। সাধনবাবুর স্ত্রী রেখাদেবীও গত মঙ্গলবার বছর খানেক ধরে নিজেদের গ্যাস উত্তমবাবুদের ব্যবহার করতে দিয়েছিলেন বলে জানান। এরপরেও, প্রধাননগরের ওই গ্যাস সরবারহকারী সংস্থা সিলিন্ডারটি তাঁদের নয় বলে দাবি করে। গত মঙ্গলবার গ্যাস সরবারহকারী সংস্থার তরফে জানানো হয়েছিল, সাধন পাল নামে নর্মদা বাগানের কোনও বাসিন্দার নামে গ্যাসের সংযোগ নেই।
বুধবার সকালের পরেই সুর বদলাতে শুরু করে সংস্থাটি। এদিন সকালে সাধন বাবুর নামে থাকা গ্যাসের নথিপত্র প্রধাননগর থানায় জমা করেন মৃতের আত্মীয়রা। এ দিন বিকেলে অবশ্য প্রধান নগরের গ্যাস সরবারহকারী সংস্থার তরফে সাধন পালের নামে সংযোগ থাকার কথা স্বীকার করা হয়েছে। সংস্থার এই ভূমিকা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন চম্পাসারির বাসিন্দারা। এক বাসিন্দার অভিযোগ, “সব নথিপত্র পুড়ে গিয়েছে বলে মনে করেই হয়ত সরবারহকারী সংস্থাটি নিজেদের আড়াল করতে চাইছিল। কিন্তু সংযোগের নথি বেরিয়ে পড়ায় সে উপায় না থাকাতেই নিজেদের সংযোগের কথা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে সংস্থাটি।”
প্রধাননগরের গ্যাস সরবারহকারী সংস্থার কর্ণধার বাপি দাস বলেন, “গ্রাহক নম্বর পাওয়ার পরে সাধন পালের নাম খুঁজে পাওয়া গিয়েছে। তবে গ্যাস লিকের বিষয়ে আমাদের কিছু করার নেই। গ্রাহকদেরই সিলিন্ডার পরীক্ষা করে নিতে হয়।” এ দিন সংস্থার নথি সূত্রে জানা গিয়েছে, গত ২ মে দুপুরে নতুন সিলিন্ডার সরবরাহ করা হয়েছিল। সে দিন দুপুরে চম্পাসারি অঞ্চল বাজারে সেই সিলিন্ডার সংগ্রহ করেছিলেন উত্তমবাবু। তাঁর সহকর্মী দ্বিজেন রায় বলেন, “আমার থেকে দু’শো টাকা নিয়ে উত্তমবাবু সিলিন্ডারটি নিয়েছিলেন।” শুক্রবার রাতে রান্নার সময় একটি গ্যাস সিলিন্ডার শেষ হওয়ার পরে, নতুন সিলিন্ডারটি লাগাতে গেলেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে বলে জানা গিয়েছে।
নিয়ম মতো সরবারহের আগে গ্যাস ওজন করে দেওয়া কিংবা ‘লিক’ রয়েছে কি না তা গ্রাহকের সামনে পরীক্ষা করে দেওয়ার কথা। এ ক্ষেত্রে কোনওটাই হয়নি বলে অভিযোগ। শুধু তাই নয়, কোনও ক্ষেত্রেই সরবরাহের আগে সিলিন্ডার ওজন করা হয় না বলে অভিযোগ। সিলিন্ডার বেহাত হয়ে অবৈধ ভাবে গ্যাস ভরে বিক্রিরও অভিযোগ রয়েছে এলাকায়। তেমনই কোনও সিলিন্ডার উত্তমবাবুর বাড়িতে পৌঁছেছিল কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে বাসিন্দাদের একাংশ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy