বিনিয়োগ টানতে ভিন্রাজ্যে তো বটেই, বিদেশেও ছুটছেন মুখ্যমন্ত্রী। পশ্চিমবঙ্গকে লগ্নির গন্তব্য হিসেবে তুলে ধরে বিভিন্ন শহরে ‘রোড শো’ করছেন শিল্পমন্ত্রী অমিত মিত্র। দু’জনেই বারবার বলছেন নয়া শিল্পনীতি ও আর্থিক সুবিধা (ইনসেনটিভ)-র কথা। অথচ এ রাজ্যে টাকা ঢেলে যে-সব বিনিয়োগকারীর সেই সুবিধা পাওয়ার কথা, সেগুলো মেটানোর দিকে বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই সরকারের। অভিযোগ, শুধু নথিবদ্ধ হওয়ার অপেক্ষাতেই গত দু’বছর ধরে পড়ে রয়েছে ২৫টি সংস্থার আবেদন! যাদের সম্মিলিত লগ্নির অঙ্ক ২,৫০০ কোটি টাকার বেশি।
রাজ্যের সংজ্ঞা অনুযায়ী, কারখানা ও যন্ত্রপাতিতে ১০ কোটির বেশি ঢাললে তা বড় শিল্প হয়। যে ২৫টি সংস্থার আবেদন পড়ে রয়েছে, তারা সকলেই কিন্তু বড় শিল্পের তালিকাভুক্ত। সংস্থাগুলির মধ্যে রয়েছে রেশমি মেটালিক্স, শাকম্ভরী ইস্পাত, সুপার স্মেল্টার ও ইমামি সিমেন্ট। যাদের বিনিয়োগ ২০০
থেকে ৪২৫ কোটি। তালিকায় থাকা প্রিয়া ফুড, এমবি ফেরো অ্যালয়, আনমোল বিস্কুটের মতো সংস্থার পুঁজি ২০-৩০ কোটি।
সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলির অভিযোগের তির শিল্প অধিকর্তার দফতরের দিকে। অভিযোগ, দীর্ঘ দিন ইনসেনটিভ আটকে থাকা নিয়ে আলোচনার সুযোগই পাওয়া যায় না। শিল্প অধিকর্তার সঙ্গে দেখা করার সময় চাইলে, তা নাকচ হয়ে যায়। শিল্প অধিকর্তা রূপেন চৌধুরীর অবশ্য দাবি, বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এর বাইরে কিছু বলতে চাননি তিনি। শিল্পমন্ত্রী অমিত মিত্র ও শিল্প সচিব এস কিশোরের কোনও প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। মন্ত্রীকে ফোন ও এসএমএস করা হয়েছে। জবাব আসেনি। সচিবকেও ই-মেল করে কোনও উত্তর মেলেনি।
ক্ষমতায় এসে পূর্বতন বাম সরকারকে টেক্কা দিয়ে লগ্নিকারীদের আর্থিক সুবিধা এক লাফে অনেকটা বাড়িয়েছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। ২০০৮ সালের ইনসেনটিভ প্রকল্পে ভ্যাটের উপর ৭০-৮০ শতাংশ ছাড় ছিল। ২০১৩ সালে তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিক্রয় করে ছাড়। দু’য়ের উপরেই ছাড় দেওয়া হচ্ছে ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ। কিন্তু সংশ্লিষ্ট শিল্পমহলের অভিযোগ, এই নীতি খাতায়-কলমেই থেকে গিয়েছে। উদ্যোগপতিরা তার সুবিধা পাননি।
নিয়ম অনুযায়ী, রাজ্যের কাছে ইনসেনটিভ পেতে ডিরেক্টরেট অব ইন্ডাস্ট্রিজ বা শিল্প অধিকর্তার দফতরে সংস্থার নাম নথিভুক্ত করতে হয়। মেলে রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট-পার্ট ওয়ান (আরসি-পার্ট ওয়ান)। এর পরে রাজ্যের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা পাওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। সেখানে পরবর্তী ধাপ হিসেবে রয়েছে আরসি-পার্ট টু বা এলিজিবিলিটি সার্টিফিকেট। আর একেবারে শেষে বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরুর শংসাপত্র। এই তিনটি ধাপ পেরোনোর পরে টাকা দেয় রাজ্য। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, গত দু’বছরের বেশি সময়ে মাত্র তিনটি সংস্থা প্রথম ধাপ পেরোতে পেরেছে! অর্থাৎ সবে আরসি-পার্ট ওয়ান পেয়েছে তারা। যেখানে আবেদন করেছে ২৮টি সংস্থা। বাকি ২৫টির ভাগ্যে এখনও শিকে ছেঁড়েনি!
২০১৩ সালে নয়া শিল্পনীতি ঘোষণা করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। দেয় এক গুচ্ছ সুযোগ-সুবিধার প্রতিশ্রুতি। শিল্পমহলের মতে, সিঙ্গুরে ন্যানো-বিদায়ের পরে ফের লগ্নিকারীদের আস্থা অর্জন করতেই ওই পদক্ষেপ করেছিল রাজ্য। ক্ষমতায় আসার দু’বছরের মধ্যে নতুন শিল্পনীতি এনে তারা বাহবাও কুড়িয়েছিল। কিন্তু শিল্পমহলের সেই ‘মুগ্ধতা’ বেশি দিন টেকেনি। প্রতিশ্রুতি ও আশ্বাসের বন্যা সত্ত্বেও বাস্তবে
পদে পদে ঠকতে হয়েছে বলে অভিযোগ তাদের। একই ভাবে পাওয়া যায়নি ইনসেনটিভও।
সরকারের অন্দরমহলের একটি অংশের যুক্তি, রাজ্য সরকারের ভাঁড়ে মা ভবানী। শিল্প সম্মেলন থেকে শুরু করে রাজনৈতিক সভা— সর্বত্র তা বলেই চলেছেন মুখ্যমন্ত্রী। ফলে সেই টানাটানির সংসারে শিল্প সংস্থাগুলিকে আর্থিক সুবিধা দেওয়ার বিষয়টি যত পিছোয়, তত মঙ্গল।
শিল্পমহল অবশ্য তা মানতে নারাজ। এক শিল্প-কর্তার দাবি, রাজ্যের টাকা না-থাকলে, বিভিন্ন পুরস্কার ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সংখ্যা ছাঁটা উচিত। তাঁর প্রশ্ন, ‘‘লগ্নিকারীদের প্রাপ্য মিটিয়ে না-দিলে নতুন বিনিয়োগ আসবে কী ভাবে?’’ বণিকসভার এক কর্তার মতে, এই আচরণে রাজ্যে বিনিয়োগের উৎসাহ আরও হারিয়ে যেতে পারে। এমনকী যে-সব সংস্থার প্রকল্প রাজ্যে রয়েছে, তারাও সম্প্রসারণের কথা ভাববে না। সে ক্ষেত্রে রাজস্ব হারাবে রাজ্য।
এক সময়ে নতুন শিল্পনীতির হাত ধরেই উৎপাদন শিল্পে ২০% বৃদ্ধির হার ছোঁয়ার কথা বলেছিল রাজ্য। তারই অঙ্গ হিসেবে ঘোষিত ইনসেনটিভ পাওয়া নিয়ে নাকাল হওয়া শিল্পমহলের প্রশ্ন, এ
ভাবে শিল্পের হাল ফেরানো আদৌ সম্ভব কি?