Advertisement
১৯ মে ২০২৪
বিবাদ এ বার বিধানসভায়

অরূপের ‘গুন্ডারাজ’ নিয়ে সরব শোভনদেব

শেষ পর্যন্ত হাটের মাঝে এসে পড়ল রাজ্যের শাসক দলের কলহ! সোমবার খাস বিধানসভার লবিতে দাঁড়িয়ে আবাসনমন্ত্রী অরূপ রায়ের মুখের উপরেই তাঁর বিরুদ্ধে ‘গুন্ডারাজ’ চালানোর অভিযোগ তুললেন তৃণমূলের মুখ্য সচেতক শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়। দাবি করলেন, তাঁর অনুগামীকে মারধর করেছে অরূপ ও তাঁর ভাই স্বরূপ বিশ্বাসের ঘনিষ্ঠ লোকজন। এই বিবাদ নিয়ে অরূপ ও শোভনদেব দু’জনেই দলের শীর্ষ নেতৃত্বের দ্বারস্থ হয়েছেন।

আহত সৌমেন মালাকারের সঙ্গে শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়। সোমবার নিউ আলিপুরে। — নিজস্ব চিত্র

আহত সৌমেন মালাকারের সঙ্গে শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়। সোমবার নিউ আলিপুরে। — নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৯ জুন ২০১৫ ০৩:৫১
Share: Save:

শেষ পর্যন্ত হাটের মাঝে এসে পড়ল রাজ্যের শাসক দলের কলহ!
সোমবার খাস বিধানসভার লবিতে দাঁড়িয়ে আবাসনমন্ত্রী অরূপ রায়ের মুখের উপরেই তাঁর বিরুদ্ধে ‘গুন্ডারাজ’ চালানোর অভিযোগ তুললেন তৃণমূলের মুখ্য সচেতক শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়। দাবি করলেন, তাঁর অনুগামীকে মারধর করেছে অরূপ ও তাঁর ভাই স্বরূপ বিশ্বাসের ঘনিষ্ঠ লোকজন। এই বিবাদ নিয়ে অরূপ ও শোভনদেব দু’জনেই দলের শীর্ষ নেতৃত্বের দ্বারস্থ হয়েছেন।
কিন্তু নেতৃত্বের হস্তক্ষেপেও যে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে রাশ টানা যাচ্ছে না, তার নজির ছড়িয়ে রাজ্যের সর্বত্র। কোথাও সিন্ডিকেট, কোথাও এলাকায় প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা, কোথাও আবার পার্কিং লটের জমি দখল ঘিরে গোলমাল। একের পর এক ঘটনায় যুযুধান শিবিরে নাম জড়াচ্ছে শাসক দলের নেতাদের। দলের তরফে বারেবারে সতর্কতা জারি করা হচ্ছে। হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন স্বয়ং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু তাতেও যে কাজের কাজ হচ্ছে না তা একান্তে কবুল করছেন তৃণমূল নেতারাই।

শোভনদেব-অরূপের প্রকাশ্য বিবাদের নেপথ্যে রবিবার রাতে নিউ আলিপুর এলাকার ৮১ নম্বর ওয়ার্ডের একটি ঘটনা। সাহাপুর কলোনি এলাকায় শোভনদেবের অনুগামী বলে পরিচিত আইএনটিটিইউসি-র এক নেতা সৌমেন মালাকারকে মারধর করা হয়। অভিযোগের তির মন্ত্রী অরূপের ভাই স্বরূপ বিশ্বাসের দলবলের দিকে। অরূপ এমন অভিযোগ অস্বীকার করলেও স্থানীয় সূত্রের খবর, এলাকায় সিন্ডিকেটের দখলদারি এবং প্রভাব বিস্তারকে ঘিরে বিরোধের সূত্রপাত। আগের রাতের ওই ঘটনার জেরেই এ দিন বিধানসভার লবিতে অরূপকে সামনে পেয়ে ক্ষোভে ফেটে পড়েন শোভনদেব। তিনি যেমন দলনেত্রী মমতাকে টেক্সট মেসেজ পাঠিয়ে ‘বিচার’ চেয়েছেন, তেমনই অরূপও দলীয় নেতৃত্বকে তাঁর তরফে যা জানানোর, জানিয়েছেন।

নিউ আলিপুরের ঘটনা বা শাসক দলের দুই প্রথম সারির নেতার বিরোধ বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় বলেই মনে করছেন রাজ্যের রাজনৈতিক নেতারা। উদাহরণ হিসেবে তাঁরা তুলে আনছেন সিন্ডিকেট-রাজ প্রসঙ্গ। শাসক দলের সূত্র জানাচ্ছে, সল্টলেক-নিউ টাউন এলাকায় সিন্ডিকেট-রাজের নিয়ন্ত্রণ ঘিরে দ্বন্দ্ব মূলত তৃণমূল বিধায়ক সব্যসাচী দত্ত ও সাংসদ কাকলি ঘোষদস্তিদারের অনুগামীদের মধ্যে। দলের শীর্ষ নেতৃত্ব বারবার সতর্ক করেছেন দুই নেতাকে। কিন্তু তা-ও সিন্ডিকেট-রাজের দাপট থামাতে যে কোনও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি, সম্প্রতি বিধানসভায় দাঁড়িয়েই সে কথা কবুল করেছেন সব্যসাচী। এক বর্ষীয়ান রাজনীতিকের কথায়, ‘‘সিন্ডিকেট-রাজের সূচনা হয় বাম জমানাতেই। তখন ক্ষেত্রবিশেষে সিপিএমের প্রভাবশালী কিছু নেতা দুষ্কৃতীদের হাতে রাখতেন। এখন গুন্ডারাই শাসক দলের নেতাদের নিয়ন্ত্রণ করছে!’’

রাজ্যের নানা প্রান্তে তোলাবাজিতেও একের পর এক নামজড়াচ্ছে তৃণমূল নেতাদের। শিল্প মহলের বড় অংশের অভিযোগ, শাসক দলের তোলাবাজির জেরে অনেকে কারখানা বন্ধ করে পাড়ি দিচ্ছেন ভিন্ রাজ্যে। অন্যরা শিকেয় তুলে রাখছেন রাজ্যে লগ্নির ভাবনা। এমনিতেই শিল্পহীন রাজ্যের পক্ষে যা গোদের উপর বিষফোড়া। শুধু শিল্প সংস্থা নয়, রাজধানী কলকাতায় দোকান খুলতে গেলেও স্থানীয় নেতার আব্দার মেটাতে হচ্ছে— এমন বিস্তর অভিযোগ তৃণমূল ভবনে আসছে বলে শাসক দল সূত্রেই খবর। তাঁদের আশঙ্কা, বিধানসভা ভোট যত এগিয়ে আসবে, ততই টাকা তুলতে মরিয়া হবেন নেতারা।

কলকাতা বন্দর এলাকার তৃণমূল নেতা মহম্মদ ইকবাল ওরফে মুন্না যেমন ফের বিতর্কে জড়িয়েছেন পার্কিং-এর জমি দখলের অভিযোগ ঘিরে। পুলিশ সূত্রের খবর, গত সপ্তাহে মুন্না ও তাঁর দলবল বন্দর এলাকার ধোবিতলার ওই জমি জোর করে দখলের চেষ্টা করে। জমির ঠিকাদার মহম্মদ মুজিমের ছেলে মহম্মদ সাজিদ বাধা দিলে তাঁকে খুনের হুমকি দেওয়া হয়। মুন্না ও তাঁর দুই সঙ্গীর বিরুদ্ধে পশ্চিম বন্দর থানায় অভিযোগ দায়ের করেন সাজিদ। মুন্না অবশ্য এ দিন তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ ‘মিথ্যা’ বলেই দাবি করেছেন।

তোলাবাজির পাশাপাশি আগামী বছরের ভোটের দিকে তাকিয়ে এলাকায় এলাকায় তৃণমূল নেতাদের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টাও জারি থাকবে বলে মনে করছেন অভিজ্ঞ রাজনীতিকরা। তাঁদের মতে, শোভনদেব-অরূপের বিবাদ এই এলাকা দখলের টানাপড়েনেরই পরিণতি। এ দিন বিধানসভায় নিজের ঘরের সামনে অরূপের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় শোভনদেবের। আশপাশে তখন কয়েক জন বিধায়ক, সাংবাদিক, নিরাপত্তারক্ষী, পুলিশ-সহ অনেকেই উপস্থিত। সকলের সামনেই শোভনদেব চড়া গলায় বলে ওঠেন, ‘‘তোরা কী শুরু করেছিস? গুন্ডারাজ চালাবি তুই আর তোর ভাই?’’ দৃশ্যতই অস্বস্তিতে পড়ে অরূপ চোখের ইশারায় শোভনদেবকে ঠান্ডা করার চেষ্টা করেন। কিন্তু শোভনদেব তখন রণং দেহি মূর্তিতে! তিনি বলে চলেন, ‘‘একটা ছেলে চা খাচ্ছে দোকানে দাঁড়িয়ে, তাকে ওই ভাবে মারবে! কী শুরু করেছিস কী তোরা?’’

অরূপ বলেন, ‘‘কী হয়েছে বলো না! আমি তো বাইরে ছিলাম। আমি কিছুই জানি না!’’ তাঁকে প্রায় থামিয়ে দিয়ে শোভনদেব বলেন ‘‘তুই ছিলি না তো কী হয়েছে? তোর ভাই তো ছিল! কেন মারল ও’ভাবে? আমি মমতাকে জানিয়ে বিচার চাইব!’’

পরে এই নিয়ে প্রশ্ন করা হলে শোভনদেব অভিযোগ করেন, রবিবার নিউ আলিপুরে মারামারির ঘটনায় অরূপের ভাই স্বরূপ বিশ্বাস জড়িত। তাঁর প্রশ্ন, ‘‘আমার বিধানসভা এলাকায় আমিই ঢুকতে পারব না! যাদের সঙ্গে দেখা করতে যাব, তাদের উপরে হামলা হবে, ভয় দেখানো হবে। এ সব কী? প্রথম থেকে এ রকম চলে আসছে। কেন চলবে?’’ ঘটনা হল, মাস দুয়েক আগে ওই ৮১ নম্বর ওয়ার্ডেই শোভনদেবের আর এক অনুগামীর বাড়িতে চড়াও হওয়া ও সংলগ্ন একটি সাংগঠনিক কার্যালয়ে ভাঙচুর চালিয়ে তালা লাগিয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল স্বরূপের অনুগামীদের বিরুদ্ধে। সে বারও বিষয়টি মমতাকে জানিয়েছিলেন শোভনদেব। মুখ্যমন্ত্রী তখন অরূপকে নির্দেশ দেন গোলমাল মিটিয়ে নিতে। তার পর অরূপ লোক মারফত কার্যালয়ের চাবি ফিরিয়ে দেন শোভনদেবকে। এ বারের ঘটনাও মুখ্যমন্ত্রীকে জানিয়েছেন শোভনদেব। তবে শাসক দলেরই এক বিধায়ক বলছেন, ‘‘একই এলাকায় অল্প দিনের মধ্যে ফের গোলমালের ঘটনা দেখিয়ে দিচ্ছে, নেত্রীর নির্দেশও কানে তুলছে না কেউ কেউ!’’

অরূপ অবশ্য শুধু বলেছেন, ‘‘এটা দলীয় ব্যাপার। আমি দলীয় নেতৃত্বকে জানিয়েছি।’’ তবে মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ শিবিরের দাবি, স্বরূপ রবিবার কলকাতায় ছিলেন না। তিনি জঙ্গলমহলে গিয়েছিলেন টালিগঞ্জ অগ্রগামীর জন্য ফুটবলার জোগাড় করতে। অরূপের ভাই ও তাঁর দলবলের কার্যকলাপ নিয়ে তৃণমূলের অন্দরেই অনেক প্রশ্ন থাকলেও এ দিন বিধানসভার লবির ঘটনায় অবশ্য শাসক দলের অনেকেই ক্ষুব্ধ। তাঁদের মত, ‘‘শোভনদা নিজের ঘরে অরূপকে ডেকে বিষয়টা বলতে পারতেন।’’ পক্ষান্তরে শোভন শিবিরের যুক্তি, ‘‘দাদা আর কত দিন দলের মধ্যে অবিচার সইবেন? সহ্যের সীমা ছাড়াচ্ছে বলেই ও ভাবে বলে ফেলেছেন।’’

এই বিষয়ে দলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘‘দলের ব্যাপার দলের মধ্যেই বলা উচিত। কারও অভিযোগ থাকলে দলীয় নেতৃত্বকে জানাতেই পারেন।’’ কিন্তু রবিবারের মারধরের ঘটনা নিয়ে দলের অবস্থান কী? পার্থবাবুর জবাব, ‘‘আমরা নজর রাখছি। যেখানে যাকে দরকার, তাকে সতর্ক করা হচ্ছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE