Advertisement
০৮ মে ২০২৪

আম্মার দুর্নীতি-রায়ের ঢেউয়ে কলরব এ বার দিদির বঙ্গেও

পটনা, রাঁচি, লখনউ, চেন্নাই...। এ বার কি কলকাতা? গুঞ্জন শুরু হয়ে গিয়েছে। জয়ললিতার জেলযাত্রা অন্য আঞ্চলিক দলের অন্দরেও জাগিয়ে তুলেছে শিহরণ! এবং সম্ভবত এই প্রথম বার, এই শিহরণ ছুঁয়ে যাচ্ছে কলকাতাকেও! পটনার লালুপ্রসাদ যাদব, রাঁচির মধু কোড়া, লখনউয়ের মায়াবতী বা চেন্নাইয়ের কানিমোঝি-এ রাজা থেকে জয়ললিতাদের নামে দুর্নীতির অভিযোগ যখন উঠেছে, বঙ্গ রাজনীতি অনেক সময়েই বড় গলায় দাবি করতে পেরেছে, ‘এ রাজ্যে ও সব হয় না’!

নিজস্ব সংবাদদাতা
নয়াদিল্লি ও কলকাতা শেষ আপডেট: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৩:১৭
Share: Save:

পটনা, রাঁচি, লখনউ, চেন্নাই...। এ বার কি কলকাতা? গুঞ্জন শুরু হয়ে গিয়েছে। জয়ললিতার জেলযাত্রা অন্য আঞ্চলিক দলের অন্দরেও জাগিয়ে তুলেছে শিহরণ!

এবং সম্ভবত এই প্রথম বার, এই শিহরণ ছুঁয়ে যাচ্ছে কলকাতাকেও! পটনার লালুপ্রসাদ যাদব, রাঁচির মধু কোড়া, লখনউয়ের মায়াবতী বা চেন্নাইয়ের কানিমোঝি-এ রাজা থেকে জয়ললিতাদের নামে দুর্নীতির অভিযোগ যখন উঠেছে, বঙ্গ রাজনীতি অনেক সময়েই বড় গলায় দাবি করতে পেরেছে, ‘এ রাজ্যে ও সব হয় না’! কিন্তু এ বার জয়ার খবর আছড়ে পড়েছে সারদা নিয়ে তোলপাড়ের মাঝে! স্বভাবতই বিরোধীরা প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন, জোড়া পাতার (এডিএমকে-র নির্বাচনী প্রতীক) দলের যদি এই পরিণতি হয়, জোড়া ফুলের কী হবে?

দেশ জুড়ে সকলেই যখন আম্মাকে নিয়ে বেঙ্গালুরুর বিশেষ আদালতের রায়কে স্বাগত জানাচ্ছেন, তৃণমূলের মুখে কিন্তু কুুলুপ! আইন আইনের পথে চলবে জাতীয় নিরাপদ ভাষণও নয়। দলীয় সূত্রের খবর, জয়াকে নিয়ে মন্তব্য করা হবে না বলে দলের অন্দরে রীতিমতো সিদ্ধান্ত হয়েছে।

তবে কলকাতা একা নয়। কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারিকা পর্যন্ত আঞ্চলিক দলের মসিহাদের অনেকেই আর নিশ্চিন্ত থাকতে পারছেন না! লালুপ্রসাদের বিরুদ্ধে পশুখাদ্য মামলার নিষ্পত্তি এখনও হয়নি। লালু বর্তমানে জামিনে মুক্ত। তবে ভোটে লড়ার অধিকার খুইয়েছেন। একই ভাবে জামিন পেয়েছেন ঝাড়খণ্ডের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মধু কোড়া। মায়াবতীর বিরুদ্ধে তাজ করিডর নিয়ে দুর্নীতির মামলা চলছে। মুলায়ম সিংহ যাদবের বিরুদ্ধেও রয়েছে আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিহীন সম্পত্তির মামলা। টুজি মামলায় অভিযুক্ত ডিএমকে-র এ রাজা, কানিমোঝিরা।

সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, অণ্ণা হজারের আন্দোলন বা আম আদমি পার্টির উত্থান প্রমাণ করে দিয়েছে, শহুরে মধ্যবিত্ত সমাজ এখন আর সরকারি দুর্নীতি মানতে রাজি নয়। সেই মানসিকতারই প্রতিফলন ঘটছে বিচার বিভাগের সক্রিয়তায়। জনমানসের ক্ষোভ টের পেয়ে কেন্দ্রে মোদীর সরকারও সিদ্ধান্ত নিয়েছে, দুর্নীতির প্রশ্নে আঞ্চলিক দলগুলির চাপের কাছে কোনও ভাবেই মাথা নোয়ানো হবে না। সুপ্রিম কোর্টে মামলাই হোক বা সিবিআই তদন্ত, কেন্দ্র এখন এ সবে নাক গলাবে না। তবে নরেন্দ্র মোদীর এ ক্ষেত্রে সেই সুবিধা আছে, যা মনমোহন সিংহের ছিল না। কংগ্রেসেরই একাংশ মনে করে, জোট রাজনীতির বাধ্যবাধকতায় আঞ্চলিক দলগুলিকে অনেক ছাড় দিতে হয়েছিল ইউপিএ সরকারকে। একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায় যে দায় মোদী সরকারের নেই। জয়ললিতার দলের নেতা এম থাম্বিদুরাই লোকসভার ডেপুটি স্পিকার। তাতেও কেন্দ্রের মনোভাবে কিছু এসে যাচ্ছে না। ঠিক যে রকম সারদা কেলেঙ্কারির সিবিআই তদন্তে ঢিলে দেওয়া হবে না বলে মোদী নিজেই আইনমন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদকে নির্দেশ দিয়েছেন।

এবং কেন্দ্রের এই অবস্থানই আঞ্চলিক দলগুলিকে আরও আতঙ্কে রাখছে! আঞ্চলিক নেতারা অবশ্য পাল্টা উদাহরণ দেখাচ্ছেন, আদর্শ আবাসন দুর্নীতির অভিযোগে মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী অশোক চহ্বাণকে পদ ছাড়তে হয়েছে। কর্নাটকে বিজেপি বি এস ইয়েদুরাপ্পাকে খনি দুর্নীতির অভিযোগে সরাতে বাধ্য হয়েছে। এমনকী ঘুষ নেওয়ার দায়ে বিজেপি সভাপতির পদ থেকে উৎখাত হতে হয়েছে বঙ্গারু লক্ষ্মণকে। মনমোহন জমানায় দুর্নীতির অভিযোগেই শশী তারুর, পবন বনসল, বীরভদ্র সিংহকে মন্ত্রীর পদ ছাড়তে হয়েছে। তা হলে শুধু আঞ্চলিক দলে দুর্নীতির বাড়বাড়ন্ত বলা হবে কেন? ডিএমকে-র সহ-সম্পাদক ভি পি দুরাইস্বামী বলেন, “এমন তো নয়, দুর্নীতি কংগ্রেস বা বিজেপিতে নেই! জাতীয় দলের বহু নেতার বিরুদ্ধেও অভিযোগ আছে।”

তৃণমূলের তরফে কেউ অবশ্য এটুকুও বলছেন না! যা বলার বলে যাচ্ছেন বিরোধীরাই। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী যেমন এ দিন বলেছেন, “জয়ললিতা হোন বা ইয়েদুরাপ্পা, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই হোন বা আমি, অন্যায় করলে জেলে যেতেই হবে!” সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য শ্যামল চক্রবর্তীর তির্যক মন্তব্য, “ইফ পটনা-চেন্নাই কাম, ক্যান কলকাতা বি ফার বিহাইন্ড?” বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ আগেই বলেছেন, “জয়ললিতাকে দুর্নীতির জন্য সরতে হচ্ছে। বঙ্গললিতার কী হবে, সেটাও এক প্রশ্ন!”

দুর্নীতির প্রশ্নে আঞ্চলিক দলগুলিকে নিয়েই বেশি চর্চা কেন? রাজনীতির বিশ্লেষকরা বলছেন, বড় দলে দুর্নীতি নেই, এমন নয়। কিন্তু আঞ্চলিক দলগুলি যে হেতু ব্যক্তিকেন্দ্রিক, সেখানে শীর্ষ নেতা-নেত্রীর নামে অভিযোগ উঠলে সার্বিক ভাবে গোটা দলই অস্তিত্বের সঙ্কটে পড়ে যায়! যেটা বড় দলে সে ভাবে হয় না। এই যুক্তি দুরাইস্বামীর মতো আঞ্চলিক নেতাও উড়িয়ে দিতে পারছেন না।

কিন্তু ভারতের রাজনীতিতে দুর্নীতি তো কোনও নতুন বিষয় নয়! তা হলে আজ তার বিরুদ্ধে এত ক্ষোভ কেন? সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের গবেষক-অধ্যাপক বিবেক দেবরায় বলছেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে ক্ষোভটা জমতে শুরু করে আশির দশক থেকেই। বফর্সের পরে ১৯৮৮-তে দুর্নীতি দমন আইন হয়। “এখন দুর্নীতির অঙ্ক বেড়েছে। নাগরিক আন্দোলন, সিএজি-র রিপোর্ট, সংবাদমাধ্যমের সক্রিয়তায় সে সব দ্রুত সামনে আসছে।”

কী এই দুর্নীতির উৎস? বিবেকবাবুর বক্তব্য, “ভোটের সময় রাজনৈতিক দলগুলিকে ব্যবসায়ীরা টাকা দেয়। সেটা বন্ধ না হলে এই বৃহত্তর দুর্নীতির সমাধান করা যাবে না। টুজি থেকে কয়লা খনি দুর্নীতি, সব কিছুর পিছনে একই কারণ। পশ্চিমবঙ্গেও সারদা কেলেঙ্কারিতে একই ছায়া।” জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক সৌমেন চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, “যারা রাজনৈতিক দলকে অর্থ জোগাচ্ছে, তারাই পরে নিজেদের স্বার্থ কুড়োতে চাইছে। যার ফলে এক শ্রেণির ব্যবসায়ী, রাজনীতিক ও আমলাদের মধ্যে দুষ্ট আঁতাঁত তৈরি হচ্ছে।”

এ কথাও সমান সত্য যে, দুর্নীতির অভিযোগ উঠলেই যে সংশ্লিষ্ট নেতা-নেত্রী বা দল জনপ্রিয়তা হারাচ্ছেন, এমনটা নয়। লালুপ্রসাদ জেলে গিয়েও ভোটব্যাঙ্ক ধরে রেখেছেন। মায়াবতী-মুলায়ম কেউই রাজনীতি থেকে হারিয়ে যাননি। সারদা কাণ্ড সত্ত্বেও সাম্প্রতিক নির্বাচনে মমতার দলের ভোট বেড়েছে। কী করে সম্ভব হচ্ছে?

বিএসপি-র রাজ্যসভা সাংসদ সতীশ মিশ্র বলছেন, বড় দলগুলো অনেক সময়ই সিবিআই বা সিএজি-কে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে আঞ্চলিক দলগুলিকে ফাঁসাতে চায়। আঞ্চলিক দলগুলিও তখন সেই দিকটা প্রচারে এনে মানুষের সহানুভূতি পায়। লালু-মুলায়ম দু’জনেই যেমন অতীতে বারবার দাবি করেছেন, অনগ্রসর শ্রেণির প্রতিনিধি বলেই উচ্চবর্ণের দলগুলো তাঁদের দাবিয়ে রাখতে চায়। ডিএমকে-র অভিযোগ, টুজি মামলায় তাদের উপরে দোষ চাপিয়ে নিজে বাঁচতে চেয়েছিল কংগ্রেস।

কিন্তু দল বা নেতারা যা-ই প্রচার করুন, মানুষ কী চান? এক দিকে যেমন দুর্নীতির বিরুদ্ধে মানুষ ফুঁসে উঠছেন, অন্য দিকে তার প্রভাব ভোটে সে ভাবে পড়ছে না কেন? লোকসভা ভোটে মোদীর সাফল্যের নেপথ্যে যদিও ইউপিএ-র দুর্নীতিগ্রস্ত ভাবমূর্তিকে অন্যতম কারণ বলে ধরা হচ্ছে। জেএনইউ-এর সেন্টার ফর ইকনমিক স্টাডিজ অ্যান্ড প্ল্যানিংয়ের অধ্যাপক সুরজিৎ মজুমদারের ব্যাখ্যা, “মানুষ শুধু দুর্নীতি দেখে ভোট দিচ্ছে না। যখন মানুষ দেখছে সরকারে যারা আছে, তারা নিজেরা টাকা কামাচ্ছে কিন্তু মানুষের জন্য কিছু করছে না, তখনই নির্দিষ্ট অভিমুখ তৈরি হচ্ছে।” আবার বিবেকবাবুর ব্যাখ্যা, টুজি বা কয়লাখনির মতো বড় অঙ্কের দুর্নীতি নিয়ে শহুরে মধ্যবিত্ত মাথা ঘামায়। গরিব মানুষ প্রশাসন এবং দলনেতাদের ঘুষের দাবি মেটাতে ব্যতিব্যস্ত। এই দু’ধরনের মানুষের কাছে ভোটের হিসেবনিকেশটা আলাদা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE