Advertisement
২৫ মার্চ ২০২৩

‘ঋণ’ শোধ করছেন সুশান্ত, সরব বিরোধীরা

রীতি ভেঙে রাজ্য নির্বাচন কমিশনার পদে আইএএস অফিসারের জায়গায় ডব্লিউবিসিএস অফিসার নিয়োগের সময়ই ভুরু কুঁচকেছিলেন অনেকে। সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন, আগের কমিশনার মীরা পাণ্ডে যে ভাবে রাজ্য সরকারের অনৈতিক কাজের প্রতিবাদ করেছিলেন, নতুন কমিশনার সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায় সেই পথে হাঁটার সাহস দেখাতে পারবেন কি না।

সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায়।

সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায়।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২২ মার্চ ২০১৫ ০২:৫৪
Share: Save:

রীতি ভেঙে রাজ্য নির্বাচন কমিশনার পদে আইএএস অফিসারের জায়গায় ডব্লিউবিসিএস অফিসার নিয়োগের সময়ই ভুরু কুঁচকেছিলেন অনেকে। সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন, আগের কমিশনার মীরা পাণ্ডে যে ভাবে রাজ্য সরকারের অনৈতিক কাজের প্রতিবাদ করেছিলেন, নতুন কমিশনার সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায় সেই পথে হাঁটার সাহস দেখাতে পারবেন কি না। দায়িত্ব নিয়ে সুশান্তবাবুও বলেছিলেন, সংঘর্ষ নয়, রাজ্য সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করেই চলতে চান তিনি। পুরভোটের মুখে সেই প্রতিশ্রুতি তিনি অক্ষরে অক্ষরে পালন করে চলেছেন বলে শনিবার কটাক্ষ করেছেন বিরোধীরা! তাঁদের বক্তব্য, এই কমিশনারের ব্যবস্থাপনায় অবাধ ভোটের আশা তাঁরা করছেন না।

Advertisement

সুশান্তবাবু নিজে অবশ্য এ দিন বলেছেন, “যদি মনে হয়, ভোটে স্বচ্ছতা-নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে পারিনি, তা হলে পদ ছেড়ে চলে যাব।” পাশাপাশি তাঁর আশ্বাস, “ভোটারদের মনে আস্থা জাগাতে তথা কমিশনের চাহিদা পূরণের জন্য সব রকম চেষ্টা চালিয়ে যাব।”

সুশান্তবাবুর বিরুদ্ধে বিরোধীদের প্রথম অভিযোগ, মেয়াদ ফুরনো কয়েকটি পুরসভায় ভোট করানোর জন্য যথেষ্ট তৎপর না-হওয়া। আদালতের নির্দেশ সত্ত্বেও লোকসভা ভোটে বিজেপির উত্থান দেখে তৃণমূল ওই সব পুরসভায় ভোট পিছিয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। দ্বিতীয় অভিযোগ, পরীক্ষার মরসুমে পুরভোট নিয়ে আপত্তি সত্ত্বেও তাকে আমল না-দেওয়া। আর সব শেষে তাদের অভিযোগ, কেন্দ্রীয় বাহিনীর তত্ত্বাবধানে ভোট করানোর ব্যাপারে রাজ্যকে যথেষ্ট চাপ দিচ্ছেন না কমিশনার।

সুশান্তবাবু অবশ্য ইতিমধ্যেই বলেছেন, ভোটারদের মনে আস্থা জাগাতে পুরভোটে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করা দরকার। কিন্তু তাঁর সেই প্রস্তাবে সায় দেয়নি রাজ্য সরকার। বিরোধীদের বক্তব্য, তার পর কেন্দ্রীয় বাহিনী আনার জন্য রাজ্য সরকারকে বাধ্য করতে যে কড়া মনোভাব দেখানো দরকার ছিল, কমিশনার তা দেখাতে বাধ্য। তিনি কার্যত রাজ্য সরকারের অঙ্গুলিহেলনেই চলছেন। এক বিরোধী নেতার কথায়, “মীরা পাণ্ডে থাকলে নিরাপত্তা ও নিরপেক্ষতার প্রশ্নে সরকারের সঙ্গে আপস না-করে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করতে আদালতের দ্বারস্থ হতেন। কিন্তু সুশান্তবাবু এখনও পর্যন্ত এমন কিছুই করেননি, যাতে সাধারণ ভোটার এবং বিরোধী দলগুলি আশ্বস্ত হতে পারে।”

Advertisement

সুশান্তবাবু নিজে এ দিন বলেছেন, “আর এক সপ্তাহ দেখব। রাজ্য সরকার কিছু না-জানালে সব পথই খোলা থাকছে।” কিন্তু সেই পথ যে আদালতে গিয়ে পৌঁছবে না, এ দিনই কার্যত তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন তিনি। তাঁর কথায় “এই পুর ভোটে ৮০ কোটি টাকা খরচ হবে। সরকার এখনও তা দেয়নি। দফতরে কর্মী নেই। স্বরাষ্ট্রসচিবকে চিঠি দিয়েছি। এখনও সব কর্মী পাইনি। সব বিষয়েই তো তা হলে মামলায় যেতে হয়। কোনও প্রতিষ্ঠান কি সব বিষয়ে মামলা করে চলতে পারে?”

কিন্তু ঘটনা হল, পঞ্চায়েত ভোটের বিজ্ঞপ্তি জারি এবং কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন নিয়ে রাজ্য সরকারের সঙ্গে লাগাতার আইনি লড়াই চালিয়েছিলেন মীরা পাণ্ডে। এবং আদালতের নির্দেশে শেষ পর্যন্ত তাঁর দাবির বেশির ভাগটাই মেনে নিতে হয়েছিল রাজ্য সরকারকে। বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের অনেকের মতে, মীরা পাণ্ডে যে ভাবে চোখে চোখ রেখে সমানে টক্কর দিয়েছিলেন, তার থেকে শিক্ষা নিয়েই সুশান্তবাবুকে ওই পদে এনেছে তৃণমূল সরকার। এবং রাজ্য সরকারের বিড়ম্বনা এড়াতে গোড়া থেকেই আদালতের পথ যথাসম্ভব এড়িয়ে চলেছেন তিনি।

গত বছর জুন মাসে মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়া ১৭টি পুরসভার নির্বাচন নিয়ে রাজ্যের সাড়াশব্দ না-পেয়ে আদালতে গিয়েছিলেন মীরা পাণ্ডেই। রাজ্য সেখানে জানায়, ৭টি পুরসভার সীমানা পুনর্বিন্যাস করা হবে। বাকি ১০টি পুরসভায় এ বছরের জানুয়ারি মাসের মধ্যে ভোট করানোর নির্দেশ দিয়েছিল আদালত। কিন্তু তার পরেও ওই পুরসভাগুলির মধ্যে বেশ কয়েকটিতে ভোট করাচ্ছে না সরকার। এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ফের কেন আদালতে গেলেন না মীরা পাণ্ডের উত্তরসূরী সুশান্তবাবু? এ দিন তাঁর ব্যাখ্যা, এই বিষয়ে একটি মামলা চলছে। সেখানেই কমিশনের বক্তব্য জানানোর সুযোগ রয়েছে। সুশান্তবাবুর কথায়, “আইনজীবীদের পরামর্শ ছিল, কমিশন রাজ্যকে জানিয়ে দিক, তারা ভোট করতে প্রস্তুত। রাজ্য ভোট না-করতে চাইলে আদালতে হলফনামা দিক।”

সুশান্তবাবুর ব্যাখ্যা মানতে নারাজ বিরোধী দলগুলি। সিপিএম রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য রবীন দেব বলেন, “মীরা পাণ্ডে দেশের সংবিধান ও রাজ্যের পঞ্চায়েত ও পুর আইন মোতাবেক কাজ করার চেষ্টা করেছিলেন। সুপ্রিম কোর্টে পর্যন্ত গিয়েছিলেন। বর্তমান কমিশনার রাজ্য সরকারের ইচ্ছার কাছে নতিস্বীকার করেছেন।” বিরোধীদের অভিযোগ, কার্যত পদের অবনমন ঘটিয়ে আইএএস-এর জায়গায় এক জন ডব্লিউবিসিএস-কে বসানোর ঋণ শোধ করছেন বর্তমান রাজ্য নির্বাচন কমিশন। শুধু মুখরক্ষার জন্য কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ে বাইরে কিছু কথা বলছেন।

সিপিএম নেতৃত্বের আরও বক্তব্য, গত ১৫ মার্চ কমিশন সর্বদল বৈঠক ডাকে। সেখানে ন’টি দল উপস্থিত ছিল। তৃণমূল ছাড়া বাকি আটটি দলই বলে, ১৮ এপ্রিল কলকাতা পুরসভার ভোট করা উচিত নয়। ওই দিন সিবিএসই পরীক্ষা রয়েছে। তা ছাড়া, উচ্চ মাধ্যমিকের জন্য প্রচারে মাইক ব্যবহার করা যাচ্ছে না। কলকাতা পুরবোর্ডের মেয়াদও ফুরোয়নি। অনায়াসে মে-জুন মাসে ভোট হতে পারে। বিরোধীদের ওই বক্তব্য কমিশন রাজ্য সরকারকে জানাবে বলে আশ্বাস দেয়। অথচ, পরের দিনই ১৮ এপ্রিল ভোট হবে বলে বিজ্ঞপ্তি জারি হয়ে যায়। রবীনবাবুদের প্রশ্ন, তা হলে সর্বদল বৈঠক ডেকে সবার কথা শোনার কী প্রয়োজন ছিল!

প্রদেশ কংগ্রেসের প্রাক্তন সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্যের মতে, “যে ভাবে কমিশনার পুরভোট পরিচালনা করতে চাইছেন, তাতে কমিশনের আলাদা অস্তিত্ব রয়েছে বলে বুঝতেই পারছি না!” বিজেপি অবশ্য সরাসরি অভিযোগ না করে সুশান্তবাবুকে পদমর্যাদা রক্ষার একটা সুযোগ দিতে চায়। দলের রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ বলেন, “রাজ্য নির্বাচন কমিশনার পদে আইএএস অফিসারের জায়গায় এক জন বিসিএস অফিসারকে নিয়োগ করায় পদের মর্যাদা নষ্ট হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছিল। যিনি ওই পদে বসেছেন, তাঁকেই নিজের কাজ দিয়ে মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে হবে।”

রাজ্য নির্বাচন কমিশনের ভূমিকায় বিরোধীরা যতই সরব হোক, তৃণমূল তাকে গুরুত্ব দিতে নারাজ। এই প্রসঙ্গে তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “আমাদের কোনও প্রতিক্রিয়া নেই। বিরোধীদের সব অভিযোগের জবাব দিতে হবে কেন?”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ)
Follow us on: Save:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE
Popup Close
Something isn't right! Please refresh.